কেরানীগঞ্জের টর্চার সেলে সাইফুলকে হত্যা কী কারণে, জানাল পুলিশ

0
101
টর্চার সেলে রাতভর নির্যাতনে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ১২ আসামি। বুধবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় চত্বরে

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রাতভর মারধর ও নির্যাতন করে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বীসহ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে মতবিরোধের জের ধরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে।

গ্রেপ্তার বাকি আসামিরা হলেন, আলমগীর হোসেন ওরফে ঠান্ডু আলমগীর (৩৯), আমির হোসেন (৩৮), মো. শিপন (৩১), দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু (৩৭), মো. রনি ওরফে ভাইস্তা রনি (৩৫), অনিক হাসান ওরফে হীরা (৩০), মো. সজীব (৩৬), ফিরোজ মিয়া (৩১), রাজীব আহমেদ (৩৫), মাহফুজুর রহমান (৩৬) ও রতন শেখ (২৮)।

আজ বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান। ঘটনার বর্ণনায় তিনি জানান, ১০ জানুয়ারি রাতে সাইফুলকে আফতাব উদ্দিন লোক দিয়ে ডাকিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন তেলঘাট এলাকায় পারভিন টাওয়ারের নিচতলায় ব্যক্তিগত কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে আফতাবের নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা লাঠিসোঁটা দিয়ে এলোপাতাড়ি রাতভর মারধর করেন সাইফুলকে। কাঁচি দিয়ে রাসেলের মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে সাইফুলের মৃত্যু হয়। দিবাগত রাত দুইটার দিকে আফতাবের নির্দেশে তাঁর কয়েকজন লোক সাইফুলকে তাঁর বাসায় দিয়ে আসেন। এ সময় তাঁরা সাইফুলের স্ত্রী মৌসুমি আক্তারকে এ বিষয়ে থানা–পুলিশসহ কাউকে কিছু না জানানোর জন্য হুমকি দেন।

ঘটনার পর রাসেলকে নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে এ ঘটনায় নিহত সাইফুলের বাবা তোফাজ্জল হাওলাদার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় আফতাব উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ১০ থেকে ১৫ জনকে।

আসামিদের দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন নিহত সাইফুল ইসলামের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার। বুধবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় চত্বরে
আসামিদের দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন নিহত সাইফুল ইসলামের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার। বুধবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় চত্বরে

আসামিদের তিন দিনের রিমান্ড

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ একটি অভিযানিক দল গঠন করে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। তদন্ত দল হত্যার ঘটনাস্থল আফতাবের কার্যালয়ে গিয়ে হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সাইফুলকে নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে ঘটনায় জড়িত আসামিদের শনাক্ত করা হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঁশবাড়িয়া বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আফতাবসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিরা হলেন সজীব, রাজীব, অনিক ও ফিরোজ। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভোলার লালমোহনে অভিযান চালিয়ে আলমগীর, আমির, রনি, দেলোয়ার, শিপন, মাহফুজুর ও রতন শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ সুপার জানান, নিহত সাইফুল মামলার প্রধান আসামি আফতাবের বন্ধু ছিলেন। আফতাবের নামে সাইফুল কালিগঞ্জ এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে ও পারস্পরিক মতবিরোধের জের ধরে আফতাব ও তাঁর সহযোগীরা সাইফুলের ওপর ক্ষিপ্ত হন। এ ঘটনার জের ধরে তাঁকে হত্যা করেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার।

সংবাদ সম্মেলনের পর গ্রেপ্তার আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে ঢাকা জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়। শুনানি শেষে বিচারক প্রত্যেকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক আবুল হাসান।

টর্চার সেলে আফতাব উদ্দিনের (সামনে বসা বাঁয়ে) পাশে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান
টর্চার সেলে আফতাব উদ্দিনের (সামনে বসা বাঁয়ে) পাশে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, ছবি: আফতাব উদ্দিনের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর প্রত্যাহার

আফতাবের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে টর্চার সেলে যাতায়াত ছিল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার। এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার‘কথা না শুনলেই তিনি ডাকেন টর্চার সেলে’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এ ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক মাসুদুরকে ওই থানা থেকে গতকাল প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, মাসুদুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দিন কবীর ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম প্রমুখ।

নিহত সাইফুল ইসলামের বাবা তোফাজ্জল হওলাদারের আহাজারি। পাশে পরিবারের সদস্যরা। বুধবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে
নিহত সাইফুল ইসলামের বাবা তোফাজ্জল হওলাদারের আহাজারি। পাশে পরিবারের সদস্যরা। বুধবার দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে

‘দেশ স্বাধীন করলাম কিয়াত্তে’

পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আসামিদের উপস্থিত করার সঙ্গে সঙ্গে বেসামাল হয়ে পড়েন সেখানে উপস্থিত নিহত সাইফুলের পরিবারের সদস্যরা। কান্না কান্না গলায় তাঁর বাবা তোফাজ্জল হাওলাদার বলেন, ‘আমি মুক্তিবাহিনীর লোক। দেশ স্বাধীন কইরা আমার ছেলে যাইবেগা (নিহত)। তাহলে দেশ স্বাধীন করলাম কিয়াত্তে (কী জন্য)। আমি ওগো সবার ফাঁসি চাই।’

নিহত রাসেলের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত রানা, রাকিব, বাপ্পিসহ বাকি আসামিদের শিগগিরই গ্রেপ্তারের দাবি জানাই। আমার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি যারা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.