বহুমাত্রিক প্রতারক বলতেই চোখের সামনে যে চেহারা ভেসে ওঠে, তাঁর নাম সাহেদ করিম। রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার ছিলেন তিনি। তবে তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। প্রতারণার ধরনে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সাহেদের সঙ্গে তুলনীয় আরেক প্রতারকের খোঁজ মিলেছে। তাঁর নাম রাজু। গাজীপুর-৩ আসনের প্রয়াত এমপি অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীর ছেলে পরিচয় দিয়ে সমাজের উঁচুতলার অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন মাসুম বিল্লাল ফারদিন রাজু। টুকটাক গানও জানেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতেও অংশ নিতেন। এমপি, মন্ত্রী, সরকারি বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে তা নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতেন তিনি। দেখতে সুদর্শন রাজুর ফেসবুক অনুসারীর সংখ্যাও চার লাখের মতো। ফেসবুক প্রোফাইলে যেসব পরিচয় তিনি বহন করে আছেন, তার ওজনও বেশ ভারী। শতাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে আছেন বলে দাবি করতেন। তবে সাহেদের মতো রাজুরও আসল চেহারা সামনে আসায় বেরিয়ে আসছে তাঁর অভিনব প্রতারণার চমকপ্রদ তথ্য। প্রতারণার জাল পাততে নিজের নাম-পরিচয় সবই বদলে দিয়েছেন তিনি।
যেভাবে বের হলো আসল পরিচয়: সম্প্রতি রাজু এক তরুণীকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। চার লাখের মতো অনুসারী ও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সভাপতি-সেক্রেটারি পদে রয়েছেন দেখে তরুণী রাজুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে ওই তরুণীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। এক পর্যায়ে তরুণীকে জাপানে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন রাজু। জাইকার প্রজেক্টে চাকরি দেওয়ার ফাঁদ পেতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে ১৯ লাখ টাকা তাঁর কাছ থেকে নিয়েছেন।
তবে জাপানে পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তরুণী বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত ওই তরুণী কলাবাগান থানায় মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ তথ্য পায়, প্রতারণার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন রাজু।
ফেসবুকে যে পরিচয় দিতেন: রাজু তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে ছিলেন বলে দাবি করতেন। তাঁর ফেসবুকে গিয়ে দেখা গেল, তিনি ফরচুন বরিশালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছাড়াও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, রয়েল ডাচ মেডিকেল কলেজের পরিচালক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সদস্য, আইনি সহায়তা কেন্দ্র আসক ফাউন্ডেশনের সদস্য, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, চিটাগং ক্লাব লিমিটেডের নির্বাহী সদস্য, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র চট্টগ্রামের সদস্য, দৈনিক গণকণ্ঠের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব, দি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, এফবিসিসিআইর সদস্য, আবাহনী ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, হবিগঞ্জের গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেলের পরিচালক, রহমতুল্লাহ ট্যানারির প্রধান নির্বাহী, বাটারফ্লাই পার্ক বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের সদস্য, জেসিআই মানিকগঞ্জের পরিচালক, সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ও ঢাকা সিপি রেড ক্রিসেন্ট ইয়ুথের আজীবন সদস্য।
প্রতারণার ধরন: ভুয়া নানা পরিচয় দিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন রাজু। এর পর গাজীপুর-৩ আসনের এমপি রহমত আলীর দ্বিতীয় ঘরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেন; কখনও আবার বলতেন, এমপিপুত্র জামিল হাসান দুর্জয়ের সৎভাই। টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার পরই বিদেশে পাঠানো, সরকারি-বেসরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়া ও বদলি-পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি অনেকের মেসেঞ্জারেও পাঠাতেন। এ ছাড়া ভিভিআইপিদের ছবি এডিট করেও প্রতারণা করেছেন। আস্থা অর্জন করতে তরুণীদের সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতে দামি দামি উপহার দিতেন। বিলাসবহুল হোটেলে পার্টি দিতেন। দেশে-বিদেশে দর্শনীয় স্থানে অনেককে ঘুরতে নেন। রাজুর তিনটি মোবাইল সেট জব্দ করে জালিয়াতির নানা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। টার্গেট করা তরুণীদের একেকজনকে একেক ধরনের পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠাতেন। মন্ত্রীর ছেলে, মন্ত্রীর ভাই ছাড়াও পুলিশ কর্মকর্তার ভাই, সরকারি কর্মকর্তার স্বামীও পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন সরকারি অফিসের কাগজপত্র জাল করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছে পাঠিয়ে দরপত্র পাইয়ে দেওয়ার সক্ষমতা আছে বলে জানাতেন। সামান্য গান-বাজনা জানার কারণে মাঝেমধ্যে স্টেজ শো করতেন। এই শোকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন।
আসল পরিচয়: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার হাজারীবাগে এক নিঃসন্তান দম্পতি আড়াই বছর থেকে রাজুকে লালনপালন করেছিলেন। কিশোর বয়সে নানা অপরাধে জড়ানোর পর বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ২০১৩ সালে প্রথম প্রতারণার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হন। নওগাঁয় সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে গিয়ে তখন ধরা পড়েছিলেন। রাজুর প্রকৃত নাম রাজু উল্যা। পড়াশোনা খুব বেশি না করলেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও আমেরিকা থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন বলে প্রচার করতেন। প্রতারণার জগতে রাজু তাঁর পরিবারের ইতিহাস ও নাম বদলে মাসুম বিল্লাহ ফারদিন বলে পরিচয় দিতেন। নিজের আগের পরিচয় লুকাতে অন্য এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে রাজু তাঁর ছবি বসিয়েছিলেন। হোটেলে হোটেলে ছিল তাঁর বসবাস। এরই মধ্যে একাধিক তরুণী প্রতারণার শিকার হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এর পরই রাজুকে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
রাজু প্রথমে দাবি করেন, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এরপর দাবি করেন, টেনেটুনে এসএসসি পাস করেছেন। নিজের গ্রামের বাড়ি ও মা-বাবার আসল পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এর পর রাজুকে যে দম্পতি লালনপালন করেছেন, তাঁদের খোঁজে নামেন গোয়েন্দারা। ডিবি কার্যালয়ে ওই দম্পতিকে ডেকে আনা হয়। তাঁরা জানিয়েছেন, কৈশোর থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ায় রাজুকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এমপি রহমত আলীর ছেলে জামিল হাসান দুর্জয় বলেন, আমরা দুই ভাই ও এক বোন। বড় ভাই জাহিদ হাসান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বোন রোমানা আলী টুসি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি। রাজু নামে আমাদের কোনো ভাই নেই। আমাদের পরিবারের সদস্য পরিচয়ে প্রতারণার বিষয়টি জানার পর পুলিশকে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।
ডিবির প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ বলেন, এখন পর্যন্ত ৪০-৪৫ তরুণীকে ফাঁদে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন রাজু।