উপাচার্যের অন্তত ১১ স্বজন চাকরি পেয়েছেন বিএসএমএমইউতে। জনবল নিয়োগ নিয়ে নানা অভিযোগ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়ম আছে, কোনো নিকট আত্মীয় পরীক্ষার্থী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপক, শিক্ষক অথবা কর্মকর্তা ওই পরীক্ষার কোনো দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। এই নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কোনো উপাচার্য ভেঙেছেন বলে শোনা যায়নি। ব্যতিক্রম বিএসএমএমইউর বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক শারফুদ্দিনের ছোট ছেলে তানভীর আহমেদ ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত স্নাতকোত্তর (এমডি/এমএস) কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, ওই পরীক্ষার সার্বিক তত্ত্বাবধান কমিটির প্রধান ছিলেন উপাচার্য নিজে।
তানভীর আহমেদ এখন বিএসএমএমইউর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি অটোল্যারিংগোলজি (নাক কান গলার সার্জারি) বিভাগে পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) পদে রয়েছেন। এই চাকরি হয়েছে তাঁর বাবার আমলে। তানভীরের বাবা অধ্যাপক শারফুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্ব পান ২০২১ সালের মার্চে।
উপাচার্যের ছেলে তানভীরের স্ত্রী ফারহানা খানম চিকিৎসক। গত ১ জানুয়ারি ফারহানার চাকরি হয়েছে বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগে।
বিএসএমএমইউর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য হলো, উপাচার্যের এ রকম অন্তত ১১ জন আত্মীয় চাকরি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের মধ্যে ৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক শারফুদ্দিন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর। বাকি চারজনের দুজন নিয়োগ পান অধ্যাপক শারফুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ-উপাচার্য থাকার সময়। আর দুজন যখন নিয়োগ পান তখন তিনি আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিএসএমএমইউ শাখার সভাপতি ছিলেন।
টাকা নিয়ে নিয়োগের অভিযোগও উঠছে। যেমন গত ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন এক যুবক। গত ৬ ফেব্রুয়ারি চাকরি দেওয়া না-দেওয়াকে কেন্দ্র করে উপাচার্যের কার্যালয়ে শারীরিক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। উপাচার্যের অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) রোববার একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।
অবশ্য উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন বলেছেন, ‘অনিয়ম করে কিছু হচ্ছে না।’
বিএসএমএমইউর জ্যেষ্ঠ অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা জানান, উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিনের স্ত্রী নাফিজা আহমেদের ভাইয়ের ছেলে সাব্বির হোসেন ২০২২ সালের এপ্রিলে শাখা কর্মকর্তা (সেকশন অফিসার) হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচালকের (পরিদর্শন) কার্যালয়ে চাকরি পান। তাঁর (উপাচার্যের স্ত্রী) আরও দুজন স্বজন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ও ল্যাবরেটরি মেডিসিনের কম্পিউটার বিভাগে চাকরি পেয়েছেন।
সাব্বির হোসেন বলেন, উপাচার্য তাঁর ‘তেমন কোনো’ আত্মীয় হন না। তিনি নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন।
উপাচার্যের আত্মীয় শারমিন আখতারকে ২০২২ সালে আগস্টে চাকরি দেওয়া হয়েছে বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের রিউমাটোলজি বিভাগে। এর আগে অধ্যাপক শারফুদ্দিনের ভাগনে এস এম বাহালুল পিয়াস আহমেদ ২০১৭ সালে নিয়োগ পেয়েছিলেন ডেসপাস শাখায়, যখন তিনি (অধ্যাপক শারফুদ্দিন) বিএসএমএমইউর সহ-উপাচার্য ছিলেন। একই সময়ে একই শাখায় চাকরি পান তাঁর (উপাচার্য) আরেক আত্মীয় মো. মিজানুর রহমান। উপাচার্যের এই আমলে তাঁর ভাগনে বাহালুলের চাচাতো বোন ফারজানা ববি চাকরি পেয়েছেন বিএসএমএমইউর লাইব্রেরিতে।
উপাচার্যের বড় ছেলে তাজবির আহমেদ বিএসএমএমইউর চক্ষু বিভাগে পরামর্শক হিসেবে চাকরি পান ২০১৩ সালে, যেটি অধ্যাপক শারফুদ্দিনের নিজের বিভাগ। তাঁর এক ভাগনে লিয়াকত হোসেন ফকির ২০১৩ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএলএসএস পদে নিয়োগ পান। উল্লেখ্য, সেই সময় অধ্যাপক শারফুদ্দিন আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন।
উপাচার্যের কার্যালয়ে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় এই প্রতিবেদক তাঁকে এসব আত্মীয়ের চাকরি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চান। উপাচার্য বলেন, সংখ্যাটি এমন হওয়ার কথা নয়। এই প্রতিবেদক বলেন, তালিকায় উপাচার্যের স্ত্রীর স্বজন রয়েছেন কয়েকজন। উপাচার্য বলেন, তিনি দুজনের কথা জানেন। তবে তিনি এও বলেন, সবাই যোগ্যতাবলে চাকরি পেয়েছেন।
অবশ্য বিএসএমএমইউর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি হয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছেন, উপাচার্যের স্বজনদের প্রায় সবাই পরীক্ষা ছাড়া চাকরি পেয়েছেন।
কৌশলে চাকরি
বিএসএমএমইউতে চাকরির ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আছে। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় চাকরির জন্য বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যত নিয়োগ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি নিয়োগ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে। অভিযোগ রয়েছে, পরে ধাপে ধাপে তাঁদের স্থায়ী করা হয়। এটা স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের একটি কৌশল বলে মনে করেন সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, স্বজনপ্রীতি করতে এই কৌশল এখন অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেই নেওয়া হচ্ছে।
২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর অস্থায়ী ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মো. মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে। নিয়োগপত্রে বলা আছে, মঞ্জুরুলের আবেদনের সূত্রে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই একই তারিখে কমপক্ষে আরও তিনজন মেডিকেল কর্মকর্তা ও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নথিপত্রে দেখা যায়, এঁদের প্রত্যেকের নিয়োগ হয়েছে তাঁদের আবেদনের সূত্রে। অর্থাৎ তাঁরা কেউ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরি পাননি।