ইউরোপের অস্ত্র শিল্পে সাজ সাজ রব, ক্রয়াদেশ আসছে ‘বানের জলের মতো’

0
141
ইউরোপের অস্ত্র ব্যবসা চাঙা হচ্ছে, রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউরোপের অস্ত্রশিল্প চাঙা হয়ে উঠেছে। জার্মানির একটি অস্ত্র কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেন বানের জলের মতো অস্ত্র বানানোর কার্যাদেশ আসছে।

জার্মানির অস্ত্র কোম্পানি রাইনমেটালের প্রধান নির্বাহী আরমিন পেপারগার দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘আমাদের এখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করতে হচ্ছে।’ এই কোম্পানি ট্যাংক থেকে শুরু করে গুলিসহ অনেক ধরনের যুদ্ধাস্ত্রই বানায়। তারা বলছে, এত এত কার্যাদেশ আসছে যে তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

১০ আগস্ট কোম্পানিটি এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। পেপারগার আশা করছেন, চলতি বছর বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ২০-৩০ শতাংশে উন্নীত হবে।রা

ইনমেটাল ১০ আগস্টের পর আরও জানিয়েছে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ড্রোনের কার্যাদেশ দিয়েছে। ফলে তাদের এখন উৎপাদনসক্ষমতা বাড়াতে হচ্ছে, সে জন্য তারা গতকাল হাঙ্গেরিতে নতুন এক কারখানা উদ্বোধন করেছে। গত বছর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় তিন গুণ হয়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পশ্চিম ইউরোপের প্রতিরক্ষা বাজেট হ্রাসের পাশাপাশি অস্ত্র ক্রয় দারুণভাবে কমে যায়। সমরাস্ত্রশিল্পের উৎপাদনও হ্রাস পায়। তবে ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা শুরু করার পর সেই শিল্প যেন আবার গতি পেয়েছে।

এ বিষয়ে সমরাস্ত্রশিল্পের মধ্যস্থতাকারী জর্জ ঝাও বলেন, ‘প্রতিরক্ষা বাজেট মূলত ভূরাজনৈতিক হুমকির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।’ এখন অনেক দেশের সরকার সেই হুমকি টের পাচ্ছে, সে কারণে সমরাস্ত্র কারখানাগুলোয় বানের জলের মতো কার্যাদেশ আসছে। বিষয়টি এখন ইউরোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সত্য হয়ে উঠেছে।

গত বছর বিশ্বের সামগ্রিক সামরিক বাজেট ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ইউরোপে—১৩ শতাংশ। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোয় এই বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি—ফিনল্যান্ডের বেড়েছে ৩৬ শতাংশ, লিথুয়ানিয়ার ২৭ শতাংশ, সুইডেনের ১২ শতাংশ ও পোল্যান্ডের ১১ শতাংশ।

ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানিও কয়েক দশকের সামরিক কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে গা ঝাড়া দিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মান সরকার সামরিক বাজেট জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেয় এবং সামরিক বাহিনীর জন্য ১১০ বিলিয়ন বা ১১ হাজার কোটি ডলারের বিশেষ তহবিল ঘোষণা করে।

এ বাস্তবতায় ইউরোপের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারীরা বড় বড় ব্যবসা পাচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে ইউরোপের মিসাইল নির্মাণকারী কোম্পানি এমবিডিএর ব্রিটিশ শাখা পোল্যান্ডের কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলারের কার্যাদেশ পেয়েছে। তারা পোল্যান্ডকে আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। গত জুন মাসে ফরাসি অস্ত্র কোম্পানি সাফরান গ্রিক আর্মির কাছে বেশ কয়েকটি কৌশলী ড্রোন বিক্রি করেছে।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্রিটেনও পিছিয়ে নেই। দেশটির সেনাবাহিনী সে দেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদানকারী কোম্পানি বিএই সিস্টেমসের কাছ থেকে আর্টিলারি বা বড় কামানের গোলা কিনছে। রাইনমেটাল প্রায় ৬ বিলিয়ন বা ৬০০ কোটি ইউরোর বিনিময়ে জার্মান ও ডাচ সরকারকে ৩ হাজার উড্ডয়ন সক্ষম যান সরবরাহ করবে। পেপারগার বলেন, এ বছর তাঁদের ইতিহাসের সেরা সময় যাচ্ছে, অন্তত উৎপাদনের দিক থেকে।

নতুন নিয়োগ

ইউরোপের সমরবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি আরও কিছুদিন চলবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় সরকারগুলো মনে করছেন, ভূরাজনৈতিক দিক থেকে নানা ধরনের হুমকি আসবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক লুসি বেরাউদ ইকোনমিস্টকে বলেন, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা আরও কিছুকাল অব্যাহত থাকবে।

অতিরিক্ত অস্ত্র উৎপাদন করতে গিয়ে রাইনমেটাল গত বছর দুই হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে এবং তাদের আরও কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা আছে। অন্যদিকে, রাইনমেটালের প্রতিদ্বন্দ্বী সুইডিস কোম্পানি সাব এক হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র কোম্পানিগুলো নতুন কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এই শিল্প সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র কোম্পানি এসটিভি গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেভিড হ্যাক রয়টার্সকে বলেন, কোম্পানির সবচেয়ে বড় কারখানা প্রাগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পোলিকায় অবস্থিত। সেখানকার কাছাকাছি এক শহরে কোম্পানির অর্থায়নে শ্রমিকদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হবে।

এমনকি এসটিভি গ্রুপ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়। অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য ক্যানটিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে তাঁদের জন্য বিনা মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব কর্মী সোভিয়েত যুগের গোলাবারুদ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমান শ্রমিকদের সহায়তা করবেন—এ–ই হচ্ছে পরিকল্পনা।

চেক প্রজাতন্ত্রের ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএসআইএ) প্রেসিডেন্ট ও নির্বাহী পরিচালক জিরি হাইনেক রয়টার্সকে বলেন, পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া না গেলে ইউরোপের বাইরেও উৎপাদন শুরু হতে পারে। তবে পর্যাপ্ত শ্রমিক ও উপকরণ পেলে চেক কোম্পানিগুলো ২০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়াতে পারবে।

রয়টার্সের সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর অস্ত্র প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মধ্য ইউরোপ। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ২০২২ সালে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ২৯টি দেশের মধ্যে পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র অনেকটাই এগিয়ে। এসব দেশ যত অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তার ২০ শতাংশেরও বেশি করেছে এই দুই দেশ।

চেক সরকার বলেছে, যুদ্ধের প্রথম ১২ মাসে ইউক্রেনে ১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরবরাহ পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে ৮৯টি ট্যাংক, ২২৬টি সাঁজোয়া যান, ৩৮টি হুইটজার কামান, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, হেলিকপ্টার, গোলাবারুদ ও রকেট।

এদিকে ইউক্রেন সরকারও অস্ত্র পেতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, শ্রমিকসংকট মেটাতে কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করবে সরকার। সে জন্য পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় শরণার্থীর মধ্য থেকে কিছু মানুষকে এসব কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে ইউক্রেন সরকার।

অস্ত্র কোম্পানিগুলোর অভিযোগ

তবে এত এত অস্ত্র কেনাবেচা সত্ত্বেও ইউরোপের অস্ত্র কোম্পানিগুলোর অভিযোগ আছে। জুন মাসে নাটোর সদর দপ্তরে ইউরোপের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে এক বৈঠকে অস্ত্রশিল্পের কর্তারা নিজেদের দুঃখ–দুর্দশার কথা তুলে ধরেন, মূলত ইউরোপ মহাদেশে অস্ত্র কোম্পানিগুলো কীভাবে কাজ করছে, তা নিয়ে।

অস্ত্র কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, ইউরোপের সরকারগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে না। ফলে কোম্পানিগুলোও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না, এই শিল্পে কত বিনিয়োগ করা সমীচীন। সুইডিশ কোম্পানি সাবের কর্তা মাইকেল জোহানসন বলেন, অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নিয়েও তাঁরা নানা অভিযোগ করেন।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইউরোপে যে একধরনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাতে ছেদ পড়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইউরোপে যে একধরনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাতে ছেদ পড়েছে।রয়টার্স

এসব সমস্যা হয়তো একসময় মিটে যাবে। ইউরোপীয় সরকারগুলো ইতিমধ্যে প্রতিরক্ষা কেনাকাটা আরও নির্বিঘ্ন করতে ব্যবস্থা নিয়েছে। জার্মানির নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনাবাহিনীর এক জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান ফ্রিউডিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও একই লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন, সেখানে ইতিমধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। নভেম্বর মাসে স্পেন ও জার্মানি ইউরোপের জন্য যুদ্ধবিমান তৈরিতে চুক্তি করেছে।

ইউরোপের প্রতিরক্ষাবিষয়ক শিল্পের মধ্যে সমন্বয় এলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এদিকে ১ আগস্ট রাইনমেটাল স্প্যানিশ অস্ত্র কোম্পানি এক্সপ্যাল অধিগ্রহণ করেছে। জোহানসন বলেন, এ ধরনের আরও একীভবন ঘটবে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইউরোপে যে একধরনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাতে ছেদ পড়েছে। অস্ত্র কোম্পানিগুলো এত দিন একভাবে চললেও ভবিষ্যতে তারা উচ্চ মুনাফা করবে বলে মনে করছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.