অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে হুড়োহুড়ি এড়াতে ঈদের দিন যাত্রা, সদরঘাটে শেষ বিল্লালের পুরো পরিবার

0
143
ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চে ওঠার সময় আরেক লঞ্চের রশির আঘাতে প্রাণ হারানো বিল্লাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগম, ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার কর্মী বিল্লাল হোসেন (৩০) বাবাকে হারিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বেঁচে আছেন কেবল মা আলেয়া বেগম। মা থাকেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। ঈদের সময় ছুটি পেয়ে বিল্লাল প্রতিবার ঈদ করতে ছুটে যান মায়ের কাছে। এবারও চেয়েছিলেন ঈদের দিন মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই মুখে দিয়ে গ্রামের ঈদগাহ ময়দানে সবার সঙ্গে নামাজ আদায় করবেন। তবে স্ত্রী মুক্তা বেগম ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ঈদের আগে বাড়িতে যাননি। ঈদের দিন যাত্রীর চাপ কম থাকবে বলে এদিন বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু ঈদের দিনের এ যাত্রাই যে তাঁর শেষ যাত্রা হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে সদরঘাটের পন্টুনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় লঞ্চের ছিঁড়ে যাওয়া মোটা রশির আঘাতে বিল্লালের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫) এবং একমাত্র শিশুসন্তান মাইশারও (৪) মৃত্যু হলো।

ঈদের দিন মায়ের মুখ দেখার বদলে বিল্লালের মরদেহ পড়ে আছে মর্গে। পরনে ঈদের আগে কেনা নতুন জামা ও জিনসের প্যান্ট। তাঁর শরীরের কোথাও তেমন আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে মাথায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। বিল্লালের পাশে রাখা হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুক্তার মরদেহ। তাঁর পরনেও ঈদের আগে কেনা নতুন জামা। আর তাঁদের আদরের একমাত্র সন্তান মাইশার মরদেহ মায়ের পাশে রাখা হয়েছে। তার পরনেও নতুন জামা।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের কর্মী মো. মিলন বলেন, ছোট্ট মাইশার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কেবল মাইশা নয়, লঞ্চের রশির আঘাতে মারা যাওয়া কারোরই শরীরে তেমন আঘাতের চিহ্ন নেই। তিনজনই মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মারা গেছেন।

জানতে চাইলে নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আশিক সাঈদ বলেন, এ ঘটনায় জড়িত ফারহান-৬ ও তাসরিফ-৪ লঞ্চের চালকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। লঞ্চ দুটি জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

মামলায় বলা হয়েছে, আসামিরা অবহেলাপূর্বক বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে লঞ্চ চালানোর ফলে লঞ্চের পুরোনো রশি ছিঁড়ে গিয়ে সেটার আঘাতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
মুহূর্তের মধ্যে যেভাবে মারা যান বিল্লালরা

পিরোজপুরে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিল্লাল হোসেন এক যুগ আগে ঢাকায় এসে চাকরি নেন পোশাক কারখানায়। এরপর ছয় বছর আগে বিয়ে করেন পিরোজপুরের মেয়ে মুক্তা বেগমকে। দুই বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান মাইশার (চার বছর) জন্ম হয়। বিল্লাল তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন গাজীপুরে। তবে পোশাক কারখানার চাকরি করে যে বেতন (১৪ হাজার টাকা), তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বিল্লাল। তাই গাজীপুরে বাসার কাছে একটি দরজির দোকান দেন তিনি। স্ত্রী দরজির দোকান চালাতেন। দুজনের আয়ে মোটামুটিভাবে টিকে ছিলেন এ দম্পতি। তবে মুক্তা বেগম অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর স্ত্রীর কথা ভেবে দরজির দোকানটি ছেড়ে দেন বিল্লাল।

স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বিল্লাল সিদ্ধান্ত নেন, স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবেন। ঈদের আগে ছুটি পেলেও স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে ঈদের আগে হুড়োহুড়ির মধ্যে তিনি ঢাকা ছেড়ে যাননি। ভেবেছিলেন, ঈদের দিন লঞ্চে ভিড় কম থাকবে। সে জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও একমাত্র আদরের মেয়েকে নিয়ে ঈদের দিন গ্রামে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে দুপুরের দিকে সদরঘাটে পৌঁছান তিনি। এরপর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া যাওয়ার উদ্দেশে বেলা দুইটার পর লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশ করেন তাঁরা। সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনে লঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন বিল্লাল, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। তখন ১১ নম্বর পন্টুনের সামনে যাত্রী ওঠানোর অপেক্ষায় ছিল এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি পূবালী-১ নামের দুটি লঞ্চ। হঠাৎ ফারহান-৬ লঞ্চটি তাসরিফের ডান পাশ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। তখন ফারহানসহ তিনটি লঞ্চের প্রায় ১০ মিনিট ধরে ধাক্কাধাক্কি হয়। সেই ধাক্কা লেগে হঠাৎ পন্টুনে বাঁধা এমভি তাসরিফের মোটা রশি ছিঁড়ে যায়। মোটা ওই রশি মুহূর্তের মধ্যে এমভি পূবালী-১–এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্লাল, তাঁর স্ত্রী, সন্তানসহ পাঁচজনকে আঘাত করে। এতে বিল্লালসহ অন্যরা পন্টুনে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। ঘটনাস্থলে তাঁরা অচেতন হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে পন্টুনে ছড়িয়ে পড়ে। আচমকা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়া যাত্রীরা বিল্লালদের উদ্ধার করে দ্রুত পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। এরপর বিকেলে ফোন পান বিল্লালের স্ত্রী মুক্তার ভগ্নিপতি জহুরুল ইসলাম। খবর শুনে তিনি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন।

মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে জহুরুল বলেন, ‘আমি আর বিল্লাল কয়েক বছর ধরে গাজীপুরে পাশাপাশি থাকতাম। সেও গার্মেন্টসে চাকরি করে, আমিও করি। ওর বেতন মাত্র ১৪ হাজার টাকা। এই বাজারে এত কম টাকায় সংসার চালানো বড় কঠিন। তাই আমার শ্যালিকার জন্য একটি দরজির দোকান করেছিল। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় দোকান বন্ধ করে তাকে বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিল্লাল।’

মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে মুক্তার ছোটবেলার ছবি দেখে কাঁদতে থাকেন তাঁর মামাতো বোন হনুফা খাতুন। তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন লঞ্চঘাট ফাঁকা থাকে। যাত্রীদের চাপ থাকে না বললেই চলে। অথচ লঞ্চচালকদের ধাক্কাধাক্কির প্রতিযোগিতার বলি হলো আমার বোনের সংসার। একটি পরিবার চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল। এর দায় কে নেবে?’

মর্মান্তিক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন লঞ্চকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দুপুর ১২টা থেকে তাসরিফ লঞ্চটি ১১ নম্বর পন্টুনে ভোলাগামী যাত্রীদের ওঠানো শুরু করে। সেটার বাঁয়ে ছিল পূবালী-১ লঞ্চ। কিছুক্ষণ পর ডান পাশে প্রথমে ফারহান-১০ লঞ্চটি আসে। তার পিছু পিছু আসে ফারহান-৬ লঞ্চ। সামান্য ফাঁকা পেয়ে ফারহান-৬–এর চালক সেখানে লঞ্চটি ঢুকিয়ে দেন। তখন ফারহান-৬ ও ১০ এবং সেগুলোর ডানে থাকা টিপু নামের লঞ্চের মধ্যে ১০ মিনিট ধরে ধাক্কাধাক্কি চলে।

একপর্যায়ে ধাক্কা লেগে তাসরিফ লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে পূবালী-১–এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের আঘাত করে। লঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় থাকা ওই যাত্রীরা সঙ্গে সঙ্গে নিচে পন্টুনের ওপর পড়ে অচেতন হয়ে যান।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.