শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন চতুর্দশ পর্ব।
চতুর্দশ দিন: এল্লা থেকে ইয়ালাবোওয়া। দূরত্ব: ৩৭.৩৮ কিলোমিটার।
এল্লা নামক এই হিল স্টেশনজুড়েই উইপোকার অসম্ভব উৎপাত। এদের ওড়াউড়ির অন্ত নেই। প্রতিটা আলোর উৎস এরা ঘিরে আছে স্বচ্ছ ডানা দিয়ে। অবশ্য রাত্রিশেষে অনেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে মেঝেতে কিংবা পথে। নক্ষত্রের জন্য পতঙ্গের বাসনা হলে বুঝি এমনই হয়!
অন্য দিনের চেয়ে হোটেল ছেড়ে একটু দেরিতে বেরোলাম। প্রথম গন্তব্য লিটন অ্যাডামস পিক। শ্রীলঙ্কার পবিত্র পাহাড় মূল অ্যাডামস পিকের খুদে সংস্করণ এটি। কালো পিচের রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার এগিয়ে ডানের ছোট রাস্তা নিলাম। চা–বাগানের মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটার ট্রেইল। ইউরোপীয় পর্যটকদের ভিড় পথে। যেখানে হাঁটাপথের ট্রেইল শেষ, সেখানে সিঁড়ি শুরু। চূড়া অবধি উঠতে অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। আজ সারমেয়রা প্রতিপক্ষ নয়। বন্ধুর মতোই আচরণ করে সঙ্গে উঠছে। পথে পড়ল ‘ফ্লাইং রাবণ অ্যাডভেঞ্চার’-এর কার্যক্রম। এখানে তারা জিপলাইন করায়। বগুড়া থেকে আসা এক দেশি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। পলিথিনে দুটো দেড় লিটারের বোতল নিয়ে তিনি পথ খুঁজছেন। নাইন আর্চ ব্রিজ হয়ে এখানে আসার পথে তাকে তিনখানা জোঁক নাকি ধরেছে। সেটা নিয়ে চরম বিরক্ত। অল্প কিছু সিঁড়ি ভেঙে লিটল অ্যাডামস পিকের মাথায়। এর উচ্চতা ১ হাজার ১৪১ মিটার। এখান থেকে পুরো এলাকার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায়। বেশ কিছু প্রকাণ্ড পাথর ছড়ানো-ছিটানো আছে এখানে-সেখানে। লোকে নানান অঙ্গ ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম নাইন আর্চ ব্রিজের পথে।
মূল সড়কের কাছে এসে এবার নিচের দিকে নেমে যাওয়া একটা শর্টকাট রাস্তা ধরলাম। মূল সড়ক ধরে গেলে পথ বাড়বে আরও দুই কিলোমিটার। মানুষের বাড়িঘর শেষ হতেই পাইনগাছের বনের মধ্য দিয়ে পথ। ঘাসের মধ্যে জোঁক কিলবিল করছে। ভাগ্যিস, স্যান্ডেল ছেড়ে জুতা পরে বেরিয়েছিলাম। ঘাসের পথের শেষে কিছু সিঁড়ি। ফের গাছের শিকড়ের মধ্য দিয়ে পথ। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। পড়িমরি করে ছুটলাম। এল্লার বিখ্যাত নাইন আর্চ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন দেখার একটা সুপ্ত ইচ্ছা আছে মনের গহিন কোণে। সেটা বুঝি মিস হয়ে গেল। ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে শেষ দুটো বগিকে ব্রিজ পেরোতে দেখলাম। অবশ্য পরে বুঝলাম এত হুড়োহুড়ি না করলেও হতো। কোনো একটা সিনেমার শুটিং হচ্ছে নাইন আর্চ ব্রিজে। ওই ট্রেনটাই সেতু ধরে বারবার আসা-যাওয়া করে যাচ্ছে। নাইন আর্চ ব্রিজ স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের বেশি সময় ধরে। নয়টা বাঁকানো খিলানের মাঝের খিলানগুলো উচ্চতায় সবচেয়ে বেশি। আর প্রান্তের খিলানগুলো মাটির নাগাল পেয়েছে বেশি দূর না গিয়েই। শত বছরের পুরোনো স্থাপত্য এখনো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে হয়। প্রচুর মানুষ এই নাইন আর্চ ব্রিজ দেখতে এসেছে। তার ওপর যুক্ত হয়েছে ফিল্ম ইউনিটের লোক। পরিচালকের নির্দেশমতে আবার উল্টো দিক থেকে চালিয়ে আনা হলো ট্রেনটিকে। এতে অবশ্য আমার মতো দর্শনার্থীদের লাভ। দুচোখ ভরে উপভোগ করে নেওয়া গেল। ভূমিধস থেকে রেললাইনকে বাঁচাতে বিশাল কর্মযজ্ঞও চলমান।
নাইন আর্চ ব্রিজ থেকে এল্লা শহরের দিকে ফেরার পথে চোখ পড়ল শহরের সবখানে মেঘ। ১ হাজার ৪১ মিটার উচ্চতার এই শহরের মাথায় সব সময় মেঘের ওড়াউড়ি। এই তো কদিন আগেই একদম সমুদ্র সমতলে ছিলাম। সমুদ্র সমতলের উচ্চতা থেকে ধীর পায়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পেরিয়ে এক হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় চলে এসেছি।
হোটেল থেকে ব্যাগপত্তর নিয়ে চিকেন চিজ কত্তু দিয়ে নাশতা সারলাম এগারোটা নাগাদ। কত্তু এমনিতেই আমার পছন্দ। চিজ যুক্ত হয়ে সেটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। পরিবেশনকারী শ্রীলঙ্কান তরুণকে ‘স্তুতি’ বলে আগে বাড়লাম। এই ‘স্তুতি’ মানে কারও বন্দনা করা নয়। সিংহলা ভাষায় ধন্যবাদই হলো স্তুতি। আজ হাঁটা শুরু করতেই ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে এগারোটা। অথচ এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে সকাল থেকে হাঁটা হয়েছে সবে সাড়ে সাত কিলোমিটার। আজকের গন্তব্য ওয়েল্লাওয়ার দূরত্ব এখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
পথে নামতেই টানা উতরাই শুরু। বাঁকানো রাস্তা ধরে শুধুই নামছি আর নামছি। রাস্তার ধারের সাইনবোর্ডে গাড়ি প্রথম গিয়ারে রেখে ধীরে নামার পরামর্শ। লিটল অ্যাডামস থেকে দেখা সেই বাঁকানো সরীসৃপের দেহের মতো রাস্তা ধরেই নামছি। রাস্তার বামে লিটল অ্যাডামসের চূড়া দেখা যাচ্ছে। এই পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কাঁধ অবধি সবুজ পাহাড়। নানান গাছপালা জন্মেছে এই অংশে। কাঁধ থেকে চূড়া পর্যন্ত অংশটুকু নিরেট পাথুরে। দূর থেকে এই পাহাড় আরও মোহনীয়। পাহাড়ের মাথায় ওঠা লোকজনের মিনিয়েচার এত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পথে বেশ কয়েকটা ভূমিধসপ্রবণ এলাকা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম রাবণ এল্লা অভয়ারণ্যে। বন্য প্রাণীকে খাবার প্রদানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে প্রতিটা সাইনবোর্ডে। দারুণ মোহনীয় সব মোচড় নিচ্ছে রাস্তা। প্রতিটা বাঁকই হাজির হচ্ছে নয়ন রঞ্জন সব দৃশ্য নিয়ে।
পথে পড়ল গোমুফ ওয়াটারফল। পাথুরে গাত্র বেয়ে অনেক ধাপে নামছে শীতল জলধারাটি।
কিছুটা এগিয়েই বিশাল উঁচু দুই পাহাড়ের খোঁড়লের মধ্য দিয়ে নেমে এসেছে রাবণ ঝরনা। প্রকাণ্ড এই জলধারা। প্রচুর লোকের ভিড় এর গোড়ায়। এই ঝরনার একদম সামনে যাওয়া যায় না। খানিকটা তফাতে থেকেই দেখতে হয় জলধারাটি। রাস্তায় প্রচুর বানর। আর রাস্তার দুই ধারের দখল হলদে বর্ণের ফুলসমেত আমেরিকান ক্যাসিয়াগাছের হাতে। প্রথম দেখায় কনকচূড়া বলে ভ্রম হয়। দেখতে বেশ নয়নাভিরাম হলেও এই গাছ দেশীয় গাছের বংশবৃদ্ধি থামিয়ে দিয়ে নিজেরাই বাড়ছে দেদার। শ্রীলঙ্কার উভা প্রভিন্সেই এরা সংখ্যায় অধিক।
সিক্রেট ওয়াটারফল পেরিয়ে বাদুল্লা জেলার সীমানা ছাড়িয়ে পা রাখলাম মনেরাগালা জেলায়। এটি শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। বৃষ্টির খপ্পরে পড়ে ফের থামতে হলো একটা দোকানে। এখানেই পাতে এল সেগুনপাতায় মোড়ানো হেলাপ্পা নামের পিঠা। পাশের বনে সেগুনগাছের সহজলভ্যতার জন্যই সম্ভবত সেগুনপাতার এমন ব্যবহার। কলাপাতা, কাঁঠালপাতায় মোড়ানো খাবার এই জীবনে বহুবার খেলেও সেগুনপাতায় মোড়ানো খাবার জিবে ঠেকল এই প্রথম। সেগুনগাছের খসখসে ভাবটা পিঠায় থাকা সত্ত্বেও নারকেলের কারণেই বেশ লাগল খেতে।
এদিকে রাস্তা মোটামুটি সমতল। পরের জনপদ কারানডাগোল্লা। এর উচ্চতা ৮৭০ মিটার। হুনুকেতিয়ার পর রাস্তা আবার নামতে শুরু করল নিচের দিকে। অধঃপতনেও এমন আনন্দ শেষ কবে পেয়েছি মনেই পড়ে না! কিছুটা এগিয়ে ইরান-শ্রীলঙ্কার বিশাল এক যৌথ প্রকল্প। সেচ মন্ত্রণালয়ের অধীনের এই প্রকল্পের সাইনবোর্ডে আছে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও শ্রীলঙ্কার অন্তর্বর্তীকালীন সাবেক প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের বিশাল ছবি।
আজ সঙ্গে পথ চলছে কিরিন্দু ওয়া নদী। স্রোতোধারা অবশ্য একেবারেই ক্ষীণ। পথে পড়ল রনদেনিয়া। এখানে একটা ওয়ার মেমোরিয়াল আছে। ১৬৩০ সালে মসলা আর রত্নের লোভে সিলনে আসা পর্তুগিজদের সঙ্গে লঙ্কানদের একটা বিশাল যুদ্ধ হয়। সিংহলিজদের রণকৌশলের কাছে হার মেনে পিছু হটতে বাধ্য হয় পর্তুগিজরা। রনদেনিয়া নামক এই জনপদের উচ্চতা ২৭০ মিটার। আজ নেমে এসেছি প্রায় ৮০০ মিটার। বেলা করে এল্লা থেকে শুরু করায় পা চালিয়ে হাঁটছি। থামাথামির অবকাশ নেই খুব একটা। এর একটা কারণও আছে। আমরা কেউই সন্ধ্যার আঁধারে হাঁটতে চাই না। পথে দোকানের সংখ্যাও অত্যল্প। তাই দুপুরের খাবারও জোটেনি। আজ দিনের শেষবেলায় এসে ময়ূর দেখলাম।
পথে হঠাৎ করে উচ্চশব্দে মিউজিক শুনে বুঝলাম বিয়ে বাড়িই এই শব্দের উৎস। বাড়ির উঠোনেই প্যান্ডেল করা হয়েছে। একটা টুকটুকের পেছনের লেখাটা বেশ মনে ধরল, ‘I can & I will, End of the story’.
রুয়েনদিয়ার পর থেকে রাস্তা একদম সমতল। সেন্ট মেরি’স চার্চ পেলাম ওয়েল্লেওয়া শহরে ঢোকার মুখেই। পুরোদিন পথচলা এ-২৩ ছেড়ে এ-২ মহাসড়কে গিয়ে উঠলাম। ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে মুখ লুকিয়েছে সূর্য। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোতে পথ চলছি। খানিক এগোতেই ওয়েল্লাওয়া শহর ছাড়াতেই সেটাও উবে গেল। পা চালিয়ে ইয়ালাবোওয়াতে থোমাশা হোমস্টেতে ঘাঁটি গেড়ে বসলাম।
বাবর আলী