প্রতি মাসেই কমছে বিদেশি মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৯০ কোটি (২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন) ডলার। তবে জনসমক্ষে প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফকে যে হিসাব দেয়, তাতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, গত ২৪ মাস বা দুই বছরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। ২০২২ সাল থেকে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহও কমছে। ২০২২ সালে যেখানে মাসে ২০০ কোটি ডলার আসত, সেখানে ২০২৩ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১৫০ থেকে ১৬০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে।
কেন রিজার্ভ কমছে—সে বিষয়ে দেশের দুজন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের মূল কথা হলো, রিজার্ভ কমে যাওয়ার মূল কারণ নীতিগত সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের কথাও বলেছেন একজন। গোষ্ঠী ও সংকীর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে তাঁদের কথায়।
রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা চলে আসে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এটা বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনার সুযোগ নেই বলে তাঁর মত।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রিজার্ভ কমার বড় কারণ হলো, এই সমস্যা বাণিজ্য ও মুদ্রানীতি দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হচ্ছে। যাঁরা তা করছেন তাঁরা মনে করছেন, টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হলে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ কিছুটা টেনে ধরা যাবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা টেকসই নয়। অর্থশাস্ত্র বলে, মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় করতে হয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সুদের হার বাড়াতে হয়, কিন্তু সরকার তা পারেনি।
সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, রিজার্ভের অর্থ যেখান থেকে আসে ও ব্যয় হয়, এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য নেই। ফলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাণিজ্য ভারসাম্য গত দুই–এক মাসে কিছুটা ভালো হয়েছে, যদিও তার অন্য তাৎপর্য আছে। আর্থিক ও চলতি হিসাবে ঘাটতি আছে। সরকারের দায়–দেনা শোধ করতে হচ্ছে। সে কারণে আর্থিক হিসাব মিলছে না।
সরকারের ঋণ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোভিডের পরপর আমরা বলেছিলাম, ২০২৩–২৪ সালে দায়–দেনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা আসছে। সেই ধাক্কা এখন এসেছে। বড় বড় প্রকল্পের জন্য যে বিভিন্ন সুদে অর্থ নেওয়া হয়েছে, তা পরিশোধের সময় এসেছে। কিন্তু এসব প্রকল্প থেকে রাতারাতি আয় আসছে না। এলেও তা বিদেশি মুদ্রায় নয়। বিশেষত বিদেশি দায়–দেনা শোধ করার কারণে মজুতের ওপর চাপ আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের অপরিশোধিত দেনা শোধ করতে হবে। আবার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি করতে হবে। ফলে মজুতের ওপর চাপ আরও বাড়বে। কেউ যদি মনে করেন, এসব পিছিয়ে দেওয়া যাবে, সেই সুযোগ তাঁরা নির্বাচন পর্যন্ত পাবেন বলে মনে করছেন না তিনি।
তবে পরিস্থিতি যতটা খারাপ হয়েছে, তা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে হয়েছে বলে মত দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এক ধরনের সংকীর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থও কাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মজুত ধরে রাখতে ব্যস্ত, যদিও তা পারছেন না। আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে গভর্নরের ভাগে পড়েছে এটি। আবার এনবিআরকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে; কিন্তু আমদানি ও বিনিয়োগ না হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। এসব ঠিক করার জন্য যে সমন্বয় দরকার ছিল, সেটা নেই। এখান থেকে উত্তরণের পথ দেখছি না; কারণ, বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
এখন আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে একলাফে সুদহার বাড়াতে হলো, যেটা তারা গত ছয় মাসে ধারাবাহিকভাবে করতে পারত বলে মত দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে টাকার মূল্যমান সমন্বয় করা দরকার ছিল। এটা সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে চিন্তার বিন্যাস ও সমন্বয়ের অভাব। এর কারণ হলো, নীতি প্রণয়নে যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, তারা অকার্যকর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্য–উপাত্তের অপর্যাপ্ততা ও তথাকথিত গোপনীয়তা।
ব্যাংক খাতের প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা শোচনীয় এবং এটি আরেকটি বড় সমস্যা। অনেক দিন ধরেই এই খাতের অবস্থা খারাপ, এখন সবচেয়ে খারাপ। ব্যাংকের সঞ্চিতির অবস্থা খারাপ। এরপর রাজস্ব আদায় কম। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ কমছে। ফলে আয় ও কর্মসংস্থান কমছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, দেশে বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ আমদানি বেড়ে যাওয়া। তিনি বলেন, ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে আমদানি হয়েছিল ৬০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের; ২০২১–২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ৫০ ডলারে। ফলে সার্বিক ভারসাম্য ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণাত্মক হয়ে গেল, আগের বছরে যা ছিল ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার ধনাত্মক।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বিশ্বজুড়ে সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে ঠিকই। তবে সারা পৃথিবীতে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলেও ব্যয় বাড়ার কথা সমপরিমাণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেল ৩২ শতাংশ। এমনকি বন্দরের হিসাবে দেখা যায়, আমদানি পণ্যের পরিমাণ বাড়েনি। আবার যে পরিমাণ রপ্তানি দেখানো হয়েছে, সেই পরিমাণে রপ্তানি আয় আসেনি—৯ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের গড়মিল আছে। তিনি বলেন, নিঃসেন্দেহে বিপুল পরিমাণ পুঁজি পাচার হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, চলতি হিসাবের রাশ টানা হলেও ঋণের সুদ ব্যয় কমেনি। আর্থিক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ, বিদেশ থেকে যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ বছরের সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩২২ দশমিক ২২ শতাংশ। সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তেই থাকবে।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বাজারে ইঙ্গিত যাচ্ছে যে এসবের প্রতিকার নেই, যদিও বাজারের এক ধরনের যৌক্তিক প্রত্যাশা থাকে। সেই সঙ্গে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে, হুন্ডি ও হাওলা বেড়ে যাচ্ছে। সংকটের সময় সাধারণত অনানুষ্ঠানিক বাজারের বাড়বাড়ন্ত হয়, এবারও তা–ই হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পুরো বিষয়টির ক্ষেত্রে এক ধরনের দায়মোচন দেওয়া আছে। ফলে দেশে বিদেশি মুদ্রার আসা কমে যাওয়ায় ধারাবাহিকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে এবং রিজার্ভ কমছে।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরও বলেন, এর মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ঋণের চাহিদাও বেশি। ঋণের মাধ্যমে অবকাঠামো হচ্ছে, কিন্তু যানজট ও লোডশেডিং কমছে না। ভোক্তা ও ব্যবহারকারীরা ঋণের কল্যাণকর প্রভাব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। ফলে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণেও বিপুল পরিমাণে ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে এবং আরও যাবে।
দেশে গোষ্ঠী শাসন চলছে বলে মনে করেন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য ঋণের বোঝা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ বর্ণিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা রাজনৈতিক বিষয় বলে মত দেন তিনি।