সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ ততই বেড়ে চলেছে। প্রায় দেড় দশক ধরে সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে চলা জাতীয় পার্টির (জাপা) দুই অংশই এখন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে।
ক্ষমতার বাইরে থাকতে চান না জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা—এমন আলোচনা দলের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। আবার সরকারের ইচ্ছার বাইরে যাওয়া জাতীয় পার্টির জন্য কঠিন—এই বাস্তবতার কথাও বলছেন নেতাদের অনেকে।
জি এম কাদেরের পক্ষের নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপ বা আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁরা সরকারকে বার্তা দিয়েছেন।
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তাঁরা বর্তমান সংবিধানের ভেতরে থেকেই উপায় বের করতে চান। সে জন্যই তাঁরা আলোচনার কথা বলছেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের গত কয়েক মাসে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতিতে সরকারের সমালোচনায় সরব ছিলেন। সেই পটভূমিতে তাঁকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একধরনের সন্দেহও তৈরি হয়েছিল। তিনি বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন কি না—এ নিয়েও নানা আলোচনা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে তাঁরা বিএনপির সঙ্গে যাচ্ছেন না।
দলের মহাসচিব মুজিবুল হক গতকাল রোববার বলেন, ‘ক্ষমতা থেকে কাউকে নামানো বা বসানোর জন্য জাতীয় পার্টি ব্যবহার হতে চায় না। সে জন্য আমরা বিএনপির এক দফার আন্দোলনে নেই। আমরা সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানের ভেতরে থেকে সমস্যার সমাধান করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই।’
দিল্লি সফরের ‘প্রভাব’
সরকারের সমালোচনা করে দেওয়া জি এম কাদেরের বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যেই চার দিনের সফরে গত ২০ আগস্ট দিল্লি গিয়েছিলেন তিনি। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে তাঁর এই সফর ছিল। দিল্লি থেকে দেশে ফেরার পর তিনি কয়েক দিন নীরব ছিলেন।
এখন নীরবতা ভেঙে দলের কর্মসূচিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু দিল্লি সফর নিয়ে বিস্তারিত কিছু তিনি বলেননি।পক্ষ থেকেও জি এম কাদেরের সঙ্গে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু দিল্লি সফর নিয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।
এর আগেও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ও ভারতের তৎপরতা দেখা গেছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে এবার নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিধিনিষেধসহ ভিসা নীতি দিয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের পটভূমিতে ভারতের ভূমিকা কী হবে—এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই দিল্লি সফর করেছেন জি এম কাদের। সে জন্য জাতীয় পার্টি কোন অবস্থান নেয়, সেদিকে সবার নজর রয়েছে।
কারণ, জি এম কাদেরসহ তাঁর পক্ষের নেতারা এত দিন বলে আসছিলেন যে রাজনৈতিক সংকট কোন দিকে গড়ায়, সে পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা দলের অবস্থান ঠিক করবেন।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলটি সরকারের সঙ্গেই থাকবে নাকি স্বতন্ত্র অবস্থান নেবে, এমন প্রশ্নে একধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিলেন জাতীয় পার্টির নেতারা। তবে এখন তাঁরা বিএনপির এক দফার সঙ্গে না গিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ’আমরা সংসদের ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
শীর্ষ দুই নেতার বিরোধ রয়ে গেছে
জি এম কাদেরের অনুসারীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন। অন্যদিকে নির্বাচন সামনে রেখেই তাঁদের সঙ্গে রওশন এরশাদের অনুসারীদের বিরোধ আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। জি এম কাদের গত ২০ আগস্ট যেদিন দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন, সেদিনই রওশন এরশাদ গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই সাক্ষাতের পরই তাঁর পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ গতকাল বলেন, জাতীয় পার্টির কিছু লোক বিএনপির সঙ্গে যেতে চায়। কিন্তু রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের বড় অংশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় দলের বর্ধিত সভা করা হবে।
নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষ এখন অনেকটা একই অবস্থানে এলেও দলের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে তাদের বিরোধ বেড়েছে। নির্বাচনের আগে তাদের বিরোধ মেটার কোনো সম্ভাবনা দেখেন না জাপার নেতারা। তাঁরা এ-ও মনে করেন, দলকে দুর্বল অবস্থানে রাখতে শীর্ষ দুই নেতার বিরোধ জিইয়ে রাখার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে।
জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন
জি এম কাদের সরকারের সমালোচনায় যতই সরব হোন না কেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় এবং এটিকে বাস্তবতা বলে মনে করেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। তাঁরা এটিও বলছেন, বিএনপিও জাতীয় পার্টিকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে। এর কারণ, বিভিন্ন সময়ে কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সিদ্ধান্ত পাল্টায়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে। ওই মহাজোটে অংশ নেওয়া নিয়ে তখন অনেক নাটকীয়তা হয়েছিল।
দলের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। এমনকি একবার চারদলীয় জোটে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত মহাজোট থেকেই সেই নির্বাচন করেছিল দলটি। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রিত্বও পেয়েছিল দলটি।
এরশাদ ও জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকেই ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে ছিল। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে এরশাদকে ঘিরে অনেক নাটকীয়তা হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও জাতীয় পার্টিকে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছিল।
তবে ওই নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির তিনজন নেতা আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন। একই সঙ্গে সংসদে বিরোধী দলের আসনেও বসেছিল দলটি। এ ধরনের নজিরবিহীন অবস্থানের কারণে দলটির প্রতি মানুষের আস্থার সংকট বেড়েছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে পারেনি জাতীয় পার্টি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন পেয়েছে। এই সংসদেও দলটি বিরোধী দলের আসনে বসেছে।
এরশাদের মৃত্যু হয় ২০১৯ সালের জুলাই। তখন দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন জি এম কাদের। সেই থেকেই দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের বিরোধ চলছে।
দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ, আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এবং দলের অবস্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব থাকায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্তি অনেক কমেছে। দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে এবং ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে শক্ত অবস্থান এখন হারানোর পথে দলটি, নেতাদের অনেকে এটি মনে করেন।
জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বৃত্তের মধ্যেই থাকতে হবে বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, নির্বাচন প্রশ্নে দলের নেতৃত্বের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা থেকেই যাবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় পার্টির পক্ষে স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়া কঠিন হবে।