দেশে গত পাঁচ বছরের প্রবণতা হলো, মধ্য আগস্টে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটে। এর পর থেকে কমতে শুরু করে এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ। এবারও তা–ই ঘটেছে। তার আগে আগস্টে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। এবার অন্তত তিনটি কারণে উদ্বেগ থাকছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে সরকার এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সভা হয় গত সোমবার। সেখানেই চলতি বছর এবং গত পাঁচ বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রবণতা তুলে ধরা হয়।
সভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তুলে ধরা প্রতিবেদনে বলা হয়, সভার আগের দুই সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে সারা দেশে মৃত্যু কমেছে ৮ শতাংশের বেশি।
তবে জনস্বাস্থ্যবিদ, চিকিৎসক এবং কীটতত্ত্ববিদদের কেউই এবারের ডেঙ্গুর সংক্রমণের নিম্নগতিতে স্বস্তি পাচ্ছেন না। অন্তত তিনটি কারণ তাঁদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে আছে থেমে থেমে বৃষ্টির প্রবণতা, ঢাকার বাইরে সংক্রমণ অনেক ছড়িয়ে যাওয়া এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামাজিক সম্পৃক্ততার অভাব।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘গত বছর আমাদের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল সেপ্টেম্বর মাস থেকে। সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবরে। তাই স্বস্তির কোনো অবকাশ নেই।’
এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গুতে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা) আরও ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ৫২৮ জন মারা গেলেন। আর চলতি মাসে মৃত্যু হলো ২৭৭ জনের। আর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ২২৪।
ডেঙ্গু সংক্রমণ কমার প্রবণতা
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে ২০০০ সাল থেকে। এরপর প্রতিবছর দেশে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এবারের আগে দেশে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছিল ২০১৯ সালে। সে বছর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটে আগস্টে। সেই মাসে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৩৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা আগস্ট মাসে দেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড।
মধ্য আগস্টের সংক্রমণ কমার প্রবণতা ২০১৮ সাল থেকেই দেখা গেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দেশে প্রবণতা হলো ৩২তম সপ্তাহের পর সংক্রমণ কমতে শুরু করে। বছরের শুরু থেকে সংক্রমণের সপ্তাহ গণনা করা হয়। সেই হিসাবে মধ্য আগস্টের পর এবারও কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে রোগী ও মৃত্যুহার। এবার ৩২তম সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৬৭৯। পরের সপ্তাহে তা কমে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮৩।
ডেঙ্গু সংক্রমণ আগস্টে বৃদ্ধির এই প্রবণতার ব্যতিক্রম ছিল গত বছর। আগস্ট মাসে গতবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে বাড়তে শুরু করে। অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়। ওই মাসে আক্রান্ত হন ২১ হাজার ৯৩২ জন। পরের মাস থেকেই অবশ্য সংক্রমণ কমতে থাকে। তবে নভেম্বরে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ডেঙ্গু রোগে।
সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছেছে ডেঙ্গু?
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এবার ডেঙ্গু সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছেছে। এখন এর প্রবণতা কমতে থাকবে ধীরে ধীরে।
গত বছর আগস্টের পর সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে কবিরুল বাশারের মন্তব্য, ‘আমাদের উপাত্ত কয়েক বছরের প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে। গত বছর কেবল ব্যতিক্রম ছিল। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা কার্যকর আছে, সেগুলোতে ঢিলেমি এলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যেতে পারে।’
তবে এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছেছে, তা বলার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখনো থেমে থেমে বৃষ্টির প্রবণতা কমেনি। বৃষ্টি কমার পর আরও অন্তত দুই সপ্তাহ যদি সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা থাকে, তবে আমরা বলতে পারব যে চূড়ায় পৌঁছেছে।’
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
ডেঙ্গু সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছা নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও কবিরুল বাশার ও মুশতাক হোসেনের অভিন্ন উদ্বেগ এবারের পরিস্থিতি নিয়ে। কারণটি হলো, ঢাকার বাইরে বিপুল সংক্রমণ। গতকাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার চেয়ে বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার বেশি।
কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু এখন গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে। আর এ কারণে এবার সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
ডেঙ্গু সংক্রমণের সাম্প্রতিক গতি নিম্নগামী হলেও বিপদ কেটে গেছে, তা বলতে রাজি নন জনস্বাস্থ্যবিদ বে–নজির আহমেদ। তিনি বলেন, করোনার ক্ষেত্রে এটা বলা সহজ ছিল। কারণ, সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হলে গণ রোগ প্রতিরোধ (হার্ড ইমিউনিটি) ক্ষমতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এমনটি বলা যায় না।
বে–নজির আহমেদের মতে, ডেঙ্গুর চারটি ধরন আছে। কোনটি কোন সময় বেড়ে যাচ্ছে, সেটা বিচার্য বিষয়। আবার এর সঙ্গে মশার বিস্তারের বিষয়টি জড়িত আছে। আছে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি। থেমে থেমে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়লে ডেঙ্গুও বাড়বে। তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেলেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে শক্ত সামাজিক সম্পৃক্ততা করা গেল না। এটি আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু ভবিষ্যতের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সামাজিক সম্পৃক্ততা জোরদার করতেই হবে।’