লাখো গ্রাহক জানেই না তাদের নামে হিসাব নম্বর

0
154
মোবাইল ব্যাংকিং

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মাড়েলহাট গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারাজুল হক। সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলে গ্রামে গিয়ে দুই ব্যক্তি কৌশলে তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ছবি নেন। এর পর একটি মেশিনে তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফারাজুলকে এক কেজি আটা দেন তারা। একইভাবে মাথাপিছু এক কেজি আটার বিনিময়ে তাঁর বাড়ি থেকে আরও চার-পাঁচজনের এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়।

গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর বোঝার সাধ্য ছিল না কী ভয়ংকর জালিয়াতির ফাঁদে পড়ছে তারা। তাদের অজান্তেই এনআইডি ও আঙুলের ছাপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খোলা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। সেগুলো দিয়ে আবার জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করে লাখ লাখ প্রতারণামূলক লেনদেন করা হচ্ছে। শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের ওই ঘটনা নয়, দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলার দরিদ্র লোকজনকে নানা সহযোগিতার ফাঁদে ফেলে তাদের এনআইডি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ নিয়ে খোলা হয়েছে লাখো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব সিমকার্ড ভয়াবহ সব অপরাধী চক্রের হাতে তুলে দিচ্ছে জালিয়াত চক্র। যাদের তথ্য নিয়ে এসব হিসাব খোলা হয়েছে, তারা থাকেন পুরোপুরি অন্ধকারে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর চালু করে দিনের পর দিন চলছে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করেছে মিরপুর থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার সাতজনের মধ্যে রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি এক বছরে ১ লাখের বেশি এনআইডির বিপরীতে জালিয়াতি করে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর খুলেছেন। এই চক্রের অন্য ছয় সদস্য হলেন– চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার সাব্বির করিম আহমেদ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের জোবায়ের আলম, বহদ্দারহাটের মোক্তার হোসেন, চন্দনাইশের অন্ত দে, বায়েজিদ বোস্তামির ফজলুল করিম নাহিদ ও কক্সবাজারের অনিক ইসলাম।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, জালিয়াত চক্রটি তিনটি ধাপে কাজটি সম্পন্ন করে। প্রথমত, প্রতারণামূলক মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর খোলে তারা। তাদের কৌশল হলো, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক অসাধু ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার ও ডিস্ট্রিবিউশন সেলস সুপারভাইজার তাদের কোম্পানির এজেন্টের মাধ্যমে ওয়ান টাইম পিন (ওটিপি) নিয়ে থাকে। এর পর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে কৌশলে তাদের এনআইডি নম্বর নিয়ে হিসাব নম্বর খোলে। দ্বিতীয়ত হলো, এসব মোবাইল সিমগুলো টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে। তৃতীয়ত, এভাবে হিসাব নম্বর খোলার পর তা অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের কাছে বিক্রি করা হয়। মিরপুর থানা পুলিশ যে চক্রটিকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের কাছ থেকে অসংখ্য সিম কিনে অনলাইনভিত্তিক একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানের নাম হলো– অ্যামাজন ডট থ্রি এস ডট কম। সেখানে বিনিয়োগ করলে মোটা অঙ্কের লাভ মিলবে এই ফাঁদে ফেলে ভুয়া অ্যামাজন প্ল্যাটফর্ম থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার লোকজনকে ফতুর করা হয়েছে। জালিয়াতির এই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এমটিএফইর প্ল্যাটফর্ম থেকে জালিয়াতি করতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যেসব নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, একই নাম্বার অ্যামাজন চক্রের কাছেও ছিল।

তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রেপ্তার সাতজনের মধ্যে কক্সবাজারের অনিক নামে একজন রয়েছে। তার কাছ থেকে ছয়টি মোবাইল ও ২৮টি সিমকার্ড পাওয়া গেছে। প্রতিটি সিমকার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর খোলা রয়েছে। তবে তার মধ্যে একটি মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরও অনিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ব্যবহার করে খোলা হয়নি। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চকরিয়ায় তোরাব আলী নামে তার চাচাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে আগেভাগে এলাকা ত্যাগ করে সে। তার বাসা থেকে ৬৮টি সিমকার্ড জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারাবন্দির স্বজনের মোবাইল নম্বর তার বাসা থেকে জব্দ করা হয়। অনিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তার চাচা অনেক সময় কারাগারের জেলার পরিচয় দিয়ে বন্দিদের স্বজনের ফোনে বলেন, ‘আপনার আত্মীয়কে জামিন পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দিলাম। এই নম্বরে টাকা পাঠান।’ কারাবন্দিদের স্বজনের ফাঁদে ফেলে চাচা-ভাতিজার এই চক্র কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জব্দ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরধারী সিমকার্ড তথ্য বলছে– গত ৪ মাসে এসব নম্বর থেকে আড়াই কোটি টাকা তুলেছেন তারা। এই চক্রের কাছে একই ধরনের আরও অনেক মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর রয়েছে।

এ ধরনের প্রতারণার শিকার একজন হলেন বরগুনার আমতলীর মো. মোজাম্মেল। পেশায় তিনি রিকশাচালক। গত ১৩ মে কারা জেলার পরিচয় দিয়ে বলা হয়– ‘তোমার আব্বা বরিশাল কারাগারে রয়েছে। সিরিয়াল নম্বর-৭১। সরকারিভাবে কিছু লোক জেলখানা থেকে ছাড়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে তোমার বাবা রয়েছে। ৪০ হাজার টাকা পাঠালে তোমার বাবাকে জামিনের ব্যবস্থা করিয়ে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ এর পর জালিয়াত চক্রকে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে ৪০ হাজার টাকা পাঠানোর পরও দরিদ্র রিকশাচালক তাঁর বাবাকে ফেরত না পেয়ে হতাশ হন। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলাও দায়ের করেন তিনি।

মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, যে চক্রটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা কয়েক লাখ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব অবৈধভাবে খুলেছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়ার নামেও কৌশলে অনেকের এনআইডি ও আইরিশ নিয়েছিল। এ ধরনের তিন-চারটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, দরিদ্র যেসব মানুষের এনআইডি কার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন চলছে তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয়।

জালিয়াতির শিকার কৃষক ফারাজুল গতকাল বুধবার বলেন, ‘হঠাৎ এক দিন পুলিশ জানাল আমার নামে মামলা হয়েছে। আমার মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দিয়ে টাকা লেনদেন করেছে প্রতারক চক্র। এটা শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। দ্রুত বালিয়াডাঙ্গী থানায় ছুটে যাই। স্যারদের বললাম আমার কোনো মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর নেই। তখন আমাকে মিরপুর থানায় যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়ে। ধারকর্জ করে থানায় যাই। এর পর পুলিশের মাধ্যমে আদালতে গিয়ে আমাকে ফাঁদে ফেলে কীভাবে এনআইডি নম্বর নেওয়া হয়েছিল সেই ঘটনা জানাই।’ একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন নাটোরের লালপুরের রূপেলা বেগম। তিনিও জানতেন না তাঁর তথ্য দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে লেনদেন করছে জালিয়াত চক্র।

পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংসেবার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত, তারা আরও সচেতন না হলে এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকানো কষ্টসাধ্য হবে। অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যাবে। আবার সতর্ক না হলে নিরপরাধ লোকজন ফেঁসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার এসআই শহীদুল ইসলাম বলেন, এই জালিয়াত চক্রের আরও কয়েকজনকে আমরা খুঁজছি। নিরপরাধ দরিদ্র এসব মানুষের এনআইডি কার্ড, আইরিশ ও ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে জালিয়াতির কথা শুনে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন বলেও জানান তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.