রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে ৫২ বছর ধরে খরস্রোতা নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাত্রীদের পৌঁছে দিচ্ছেন রমেশ মাঝি। তাঁর বাবা যজ্ঞেশ্বর মাঝি, ঠাকুর দা ধনঞ্জয় মাঝিও একইভাবে নৌকায় মানুষ পারাপার করতেন। তিন পুরুষ ধরে যাত্রী পারাপার করেও রমেশ মাঝিরা নেন না টাকা। গ্রামের কৃষকসহ লোকজনের দেওয়া খাদ্যশস্যে চলে তাঁদের সংসার।
ষাটোর্ধ্ব রমেশ মাঝি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার জপসা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা। কীর্তিনাশা নদীর লক্ষ্মীপুর ঘাটে নৌকা চালান তিনি।
নড়িয়া উপজেলার ওপর দিয়ে কীর্তিনাশা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পূর্ব তীরে উপজেলা সদর, জেলা সদর, জেলার গুরুত্বপূর্ণ হাট ভোজেশ্বর বাজার। পশ্চিম তীরে জপসা, নশাসন, রাজনগর ও মোক্তারেরচর ইউনিয়নের অবস্থান। ওই ৪ ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ কীর্তিনাশা নদী পারাপার হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। অন্তত শত বছর ধরে লক্ষ্মীপুর ঘাটে যাত্রী পারাপারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন রমেশ মাঝির পরিবার।
গ্রামবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রমেশের বয়স এখন ৬২ বছর। ১০ বছর বয়সে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকায় ওঠেন তিনি। গত ৫২ বছরে নৌকা থেকে আর নামতে পারেননি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা রমেশ। তাঁর নৌকা দিয়ে পারাপার হয়ে এলাকার অনেক ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু অর্থাভাবে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। রমেশ দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। পৈত্রিক আট শতক জমির ওপর রমেশের বাড়ি। সেখানে স্ত্রী চায়না রানী, ছেলে হৃদয় মাঝি (৩৮) ও সেতু মাঝিকে (৩৫) নিয়ে বসবাস করেন। দুই ছেলে কাঠমিস্ত্রীর কাজ করেন। তাঁরা বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন।
চায়না রানী বলেন, ‘৪০ বছর ধরে আমরা সংসার করছি। সব সময় অভাব লেগে আছে। এ কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি, কিন্তু তিনি (রমেশ মাঝি) রাজি হননি। এটাকে মানবসেবার ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই। বৃদ্ধ বয়সে কী হবে, তা ভেবে মাঝেমধ্যে চোখের পানি ফেলি।’
জপসা ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা শহীদুল ইসলাম শৈশব থেকে রমেশ মাঝির নিয়মিত যাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা রমেশ কাকার নৌকায় পারাপার হয়ে স্কুল–কলেজে যেতাম। তিনি টাকা নিতেন না। আর কেউ তাঁকে টাকা দেনও না। এটা একধরনের রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। ফসল উঠলে কৃষকসহ এলাকার লোকজন তাঁকে ধান, পেঁয়াজ ও রসুন দিতেন। ওই সামান্য সহযোগিতায় তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করছেন। এমন একজন নির্লোভ মানুষ বর্তমান সমাজে বিরল।’
জপসা গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত মোল্যা বলেন, ‘রমেশ মাঝির নৌকায় পারাপার হয়ে আসছি বছরের পর বছর ধরে। আমরা সমাজের নানা স্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। কিন্তু তাঁর দিকে কেউ ফিরে তাকাইনি। মানুষটা চাইলে ও চেষ্টা করলে গত ৫২ বছরে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারতেন। মাঝেমধ্যে ভাবলে কষ্ট লাগে।’
রমেশ মাঝি বলেন, মানবসেবার এ শিক্ষা ঠাকুর দা ও বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তাঁরাও নৌকায় মানুষ পারাপার করে টাকা নিতেন না। গ্রামের মানুষ জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন ফসল দিত। তা দিয়েই দুবেলা দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা হয়।
বাড়িতে একটা নলকূপ নেই রমেশ মাঝির। ৫০০ মিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। অনেককে বলেছেন, কিন্তু কেউ সাহায্য করেননি। বর্তমান সরকারের বয়স্কভাতা হিসেবে মাসে ৫০০ করে টাকা পান রমেশ। তিনি বলেন, ‘জীবনের পুরো সময়টাই মানুষ পারাপার করেছেন, কখনো নিজের উন্নতির কথা ভাবেননি। এখন এসে অভাব বোধ করছেন। কোনো সম্পদ ও সঞ্চয় নেই। বৃদ্ধবয়সে কীভাবে জীবন কাটবে, তা নিয়ে চিন্তা হয়।’
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, ‘টাকা ছাড়া নৌকায় মানুষ পারাপার করে রমেশ মাঝি সমাজে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বিরল। সরকার এমন মানুষের পাশে সব সময় আছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসন থেকে রমেশ মাঝির পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করব।’