কোস্টারিকায় ১৬ বছর ধরে নিঃসঙ্গ এক কুমির সম্প্রতি সন্তান জন্ম (ভার্জিন বার্থ) দিয়েছে। এ ঘটনা ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের কাছে বিষয়টি উদ্ভট ঠেকলেও প্রাণিজগতে যৌন সংসর্গ ছাড়া এ ধরনের প্রজননের ঘটনা অপরিচিত নয়।
যে কুমিরকে ঘিরে এত আলোচনা, সেটির নাম কোকিতা। কোস্টারিকার ‘পারকে রেপতিলাঁদিয়া’ চিড়িয়াখানায় সে ১৬ বছর ধরে সঙ্গীহীন অবস্থায় আছে। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে কোকিতা কিছু ডিম পেড়েছিল। পরে দেখা যায়, একটি ডিমে কুমিরের পরিণত ভ্রূণ আছে। এত দিন নিঃসঙ্গ থাকা কুমিরটির পুরুষ সঙ্গীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এরপরও তার ডিমে পরিণত ভ্রূণ পাওয়ার ঘটনাটি রহস্যের জন্ম দেয়।
৭ জুন বায়োলজি লেটারস নামের সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এর কারণ ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা মনে করেন, আরও কিছু প্রাণীর মতো কুমিরও পার্থেনোজেনেসিস (যৌন সংসর্গ ছাড়া জন্মদান) ধরনের মাধ্যমে প্রজননে সক্ষম। এই পদ্ধতিতে পুরুষ সঙ্গীর সংসর্গ ছাড়াই যেসব ডিম দিয়েছে, সেগুলোয় পরিণত ভ্রূণ হতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চিড়িয়াখানায় বন্দী থাকা সরীসৃপ প্রাণীদের ডিম পাড়ার ঘটনা অপরিচিত নয়। তবে কুমিরটি যে পরিমাণ সময় নিঃসঙ্গ ছিল, তাতে সাধারণত এ ধরনের ডিমকে প্রজননের অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে কোকিতার পাড়া ১৪টি ডিম পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা ব্যতিক্রম দেখতে পান। তাঁরা সাতটি ডিমকে প্রজননযোগ্য হিসেবে বাছাই করেন এবং এগুলোকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ফোটানোর সিদ্ধান্ত নেন।
শেষ পর্যন্ত সাতটি ডিমের মধ্যে মাত্র একটিতে পরিণত ভ্রূণ পাওয়া গেছে। তবে এ ডিমটি ফোটেনি। ভ্রূণটি মৃত ছিল।
পরে ভ্রূণটির একটি নমুনা কোস্টারিকা থেকে ড. ওয়ারেন বুথের কাছে পাঠানো হয়। বুথ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে পার্থেনোজেনেসিস নিয়ে গবেষণা করছেন। বায়োলজি লেটারস নামের সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণাকাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
ড. ওয়ারেন বুথ কুমিরের ওই মৃত ভ্রূণটির ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেন, এটি পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। পার্থেনোজেনেসিস হচ্ছে, জিনের এমন একটি ধরন, যার সঙ্গে মায়ের জিনের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মিল থাকে।
প্রাণীদের ‘ভার্জিন বার্থ’-এর ইতিহাস
এক শতাব্দীর বেশি সময় আগে থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, কিছু প্রাণী পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ ছাড়াই প্রজননযোগ্য ডিম দিতে সক্ষম। বুথ বলেন, সর্বপ্রথম বিজ্ঞানীরা কবুতরের মধ্যে এমনটা আবিষ্কার করেন।
পরে সাপসহ আরও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে পার্থেনোজেনেসিসের উপস্থিতি দেখা গেছে। পাখি, টিকটিকি, কচ্ছপ এবং হাঙরের মধ্যেও এ ধরনের প্রজনন সক্ষমতা দেখা গেছে। এবার কুমিরও সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
গবেষকেরা মনে করছেন, পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই প্রাণীরা ডিম পাড়ার পর সেগুলো প্রজননযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা করা উচিত। তবে ওয়ারেন বুথ মনে করেন, পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় যেসব ভ্রূণ উৎপন্ন হয়ে থাকে, সেগুলোর বেশির ভাগই খুব অসুস্থ কিংবা দুর্বল হয়ে থাকে।
পার্থেনোজেনেসিস কীভাবে কাজ করে
পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় যেসব ভ্রূণ উৎপন্ন হয়, সেগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গে মায়ের ডিএনএর মিল থাকে। নির্দিষ্ট ধরনের ক্রোমোজোম থাকা প্রাণীদের ক্ষেত্রে শুধু এমনটা দেখা যায়।
বুথ বলেন, মানুষ কিংবা অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা হয় না। কারণ, তাদের ক্ষেত্রে ভ্রূণ গঠনের জন্য নারী ও পুরুষ-দুজনের কাছ থেকেই সুনির্দিষ্ট কিছু জিন দরকার হয়।
গবেষক ওয়ারেন বুথ মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। গবেষকেরা পরীক্ষাগারে পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় সফলভাবে ইঁদুর উৎপাদন করেছেন। তবে এ জন্য তাঁদের অনেকটাই জিন সম্পাদনা করতে হয়েছে। তাঁদের যথাযথ সময়ের মধ্যে জিন স্থানান্তর করতে হয়েছে।
বুথ মনে করেন, পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় কুমিরের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতার বিষয়টি আবিষ্কার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মার্কিন এই গবেষকের ধারণা, কুমির ও পাখিরা তাদের অনেক অনেক দূরবর্তী স্বজন ডাইনোসরের কাছ থেকে এ ধরনের সক্ষমতা অর্জন করে থাকতে পারে। যদিও ডাইনোসরের ডিএনএ ছাড়া এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণের সুযোগ বিজ্ঞানীদের নেই।