জায়গাটির নাম নাওডোবা। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের এই ইউনিয়নটি এক সময় নদীভাঙা লোকের আবাস ছিল। চর এলাকা বলে বাদাম ছাড়া কিছু ফলত না। কিছু কিছু জমিতে পাটও হতো। দারিদ্র্যপীড়িত সেই নাওডোবা এখন চকচকে শহর। ঐতিহ্যবাহী নাওডোবা হাটের দোকানপাটও সব পাকা। পদ্মা সেতুর এই দক্ষিণ পাড়েই রয়েছে শেখ রাসেল ক্যান্টনমেন্ট, শেখ হাসিনা তাঁতশিল্প এলাকা এবং সেতুর সার্ভিস এরিয়া। এই ইউনিয়নের বুকের ওপর দিয়েই চলে গেছে পদ্মা সেতু থেকে নামা এক্সপ্রেসওয়ে। এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে নির্মিত হচ্ছে গার্মেন্ট, হিমাগার, পেট্রোল পাম্প ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বাস পৌঁছে গেল নাওডোবা বাসস্ট্যান্ডে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে আসতে লাগল মোটে এক ঘণ্টা। এর মধ্যে নানা স্টপেজে যাত্রী ওঠানামা, যাত্রাবিরতির সময়ও আছে। নাওডোবা বাসস্ট্যান্ডেরই লাগোয়া চায়ের দোকানে এই ভোরেও দেখা গেল শ্রমজীবী মানুষের ভিড়। আছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। ট্রাকে তাঁদের মালপত্র লোড দিতে এসেছেন। মালপত্র বলতে কৃষিজাত পণ্য ও মাছ। সেখানেই কথা হয় নাওডোবা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আবদুস সোবহানের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, ১০১ নম্বর নাওডোবা মৌজায় পদ্মা সেতু হওয়ার আগে জমির দাম প্রতি শতাংশ ছিল মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। গত বছরের জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর অনেকটা ম্যাজিকের মতোই এখন রাতারাতি দাম বেড়ে গেছে। এখন এই মৌজায় প্রতি শতাংশ জমির দাম ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। মূল সড়ক ও বাজারের কাছাকাছি হলে দাম আরও বেশি। জমির দাম বাড়ায় বেড়েছে ভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার। সচ্ছল হয়ে উঠছেন গৃহস্থরা।
ঢাকায় পড়ালেখার হাতছানি
নাওডোবা বাজার থেকে অটোরিকশায় চেপে যাওয়া হলো মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাচ্চর বাজারে। পাচ্চর বাজার বাসস্ট্যান্ডের স্যালুন ব্যবসায়ী কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের মাগুরখণ্ড গ্রামের তোতা মিয়া বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষ হলেও তিনি তাঁর তিন সন্তানকে পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু হওয়ার পর পাড়া-প্রতিবেশীর পরামর্শে তিনি বড় সন্তানকে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে অনার্সে ভর্তি করিয়েছেন। সপ্তাহে এক দিন ঢাকায় গিয়ে সন্তানকে দেখে আসেন; বেশি সময় লাগে না। স্থানীয়রা জানান, পদ্মা সেতু হওয়ায় অন্যান্য উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষও এখন সন্তানকে ঢাকায় পড়ালেখা করতে পাঠাচ্ছেন।
ভাঙ্গা মোড়ের আকর্ষণে
বিশাইকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ফজলু চোকদার কাউন্টার মাস্টার হিসেবে কাজ করছেন এই বাসস্ট্যান্ডে। তিনি জানান, সেতু চালুর পর তাঁদের আয় বেড়েছে অনেক। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সব বাস এই রুট হয়ে যাতায়াত করছে। পরিবহন মালিকরা নতুন নতুন বাস নামিয়েছেন। পরিবহন খাতে বিনিয়োগ হয়েছে বিপুল অর্থ।
আরও এগোলে পড়বে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা। জায়গাটিকে রাতারাতিই বদলে দিয়েছে পদ্মা সেতু ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক। ভাঙ্গা গোলচক্কর এলাকায় দেখা গেল, নতুন নতুন চায়নিজ রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। এগুলোতে প্রবাসীরাও বিনিয়োগ করেছেন। ভাঙ্গা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ছিলাধরচর গ্রামের বাসিন্দা ছাইদুল শেখ জানান, টানা ১৭ বছর পর মালয়েশিয়ায় প্রবাস জীবন কাটিয়ে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন তিনি। এবার ভাঙ্গায় ফিরে হকচকিয়ে গেছেন! বাস থেকে নেমে নিজের এলাকাকেই চিনতে পারছিলেন না! বিশ্বমানের এক্সপ্রেসওয়ে আর ভাঙ্গার অত্যাধুনিক সড়ক সংযোগ (ইন্টারসেকশন) তাঁর কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর। তাঁর মনে হচ্ছিল, যেন নতুন এক মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন তিনি। ফরিদপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা থেকে ৩পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত মাত্র ৫৫ কিলোমিটার পথ হচ্ছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। এশিয়ান হাইওয়ের করিডোর-১ এর অংশ এই সড়কটি।
দক্ষিণে শিল্পায়নে গতি
পদ্মা সেতুর আর্থসামাজিক সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন ফরিদপুরের বাসিন্দারাও। শিল্পায়নের পথে পা বাড়িয়েছে সুপ্রাচীন এই জেলা। হা-মীম গ্রুপ, আকিজ গ্রুপসহ দেশের বড় ও খ্যাতনামা বেশ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী জমি কিনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। নগরকান্দায় ৫০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পপার্ক। আলাপকালে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহ্সান তালুকদার বলেন, আমরা পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সুফল ফরিদপুরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। সব উদ্যোক্তাকে ফরিদপুরের প্রশাসন সর্বোচ্চ উৎসাহ জোগাবে ও সহযোগিতা করবে।
ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, ফরিদপুর-ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে সব মিলিয়ে একশটি নতুন ট্রিপ দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। এসব বাসে তিনজন করে স্টাফ হলেও তিনশ নতুন শ্রমিক যুক্ত হয়েছে পরিবহন খাতে। এসব পরিবারের আয় বেড়েছে। তবে পরিবহন ব্যবসা বাড়ার ফলে অন্যান্য পেশাজীবীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেক।
কৃষি খাতে নতুন উদ্দীপনা
নাওডোবা বাজারে বসেই কথা হয় শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. জামাল হোসেনের। তিনি বলেন, তাজা শাকসবজি দিনে দিনেই চলে যাচ্ছে ঢাকার বাজারে। এতে কৃষক ও সবজি ব্যবসায়ী সবাই খুশি। এখানকার কৃষকের সঙ্গে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য বাজারের দূরত্ব কমে গেছে। ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার দুর্বিষহ দিন আর নেই।
গত ৫ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ফরিদপুরে। সেতুর কারণে সড়ক যোগাযোগ বাড়ায় ঢাকাসহ সারাদেশে চলে যাচ্ছে ফরিদপুরের পেঁয়াজ। পাটসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা। ফরিদপুরের পর্যটন খাতও অনেক চাঙ্গা।
যশোরের পালবাড়ী মোড়ে দাঁড়িয়ে সবজি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম নজু বললেন, ‘এহন তরিতরিকারি দিনিরডা দিনিই পৌঁছি যায় ঢাকায়। নড়াইল-লুহাগাড়া হয়ে কালনা ব্রিজ, তার পর পদ্মা সেতু, রাস্তা অনেক কুইমে গেছে।’ উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নে দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ পাইকারি সবজির মোকাম ‘বারিনগর সাতমাইল সবজির হাট।’ এই হাটে যশোর সদর, চৌগাছা, পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের কৃষকদের সবজি পাইকারি বিক্রি হয়। এই বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ টন সবজি পাইকারদের মাধ্যমে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। একইভাবে যাচ্ছে যশোরের ফুলও। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, যশোরের গদখালির ফুলচাষিরা প্রায় ১৩ ধরনের ফুলের চাষ করেন। বছরে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ফুল যশোর থেকে সারাদেশে ছড়ানোয় মূল ভূমিকা রাখে পরিবহন। এক সময় ফেরিঘাটে পড়ে থেকে ফুলের মান নষ্ট হয়ে যেত। এখন গদখালির ফুল তিন থেকে চার ঘণ্টায় ঢাকা শহরে চলে যাচ্ছে।
আয় বেড়েছে মাছচাষিদেরও
যশোর হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ আহমেদ গোলদার বলেন, ‘যশোরে গুণগত মানসম্পন্ন মাছের রেণু, পোনা ও খাওয়ার উপযোগী মাছ চাষ হয়। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়াতে আমাদের হ্যাচারি কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকায় মাছ পাঠাতে গেলে ফেরিঘাটের জ্যামের কারণে ১০/১২ ঘণ্টা সময় লাগত। অনেক সময় তো ২৪ ঘণ্টাও পার হয়ে যেত। অধিক সময়ের কারণে রেণু, পোনা মারা যেত, বড় মাছগুলোর পচন শুরু হতো। অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষতি হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়াতে আমরা ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় মাছ পৌঁছাতে পারছি।’
জমজমাট বেনাপোল স্থলবন্দর
বেনাপোল স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা গেল, পদ্মা সেতুর কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে গতি বেড়েছে বেনাপোল স্থলবন্দরে। কম খরচে ও অল্প সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন দেশের বৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীরাও। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সহজ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবাদে আরও গতিশীল হয়ে উঠছে এই বন্দর। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, এখন আর কোনো বাধা নেই। ব্যবসায়ীরা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই ট্রাকে মালপত্র নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দ্রুত পরিবহনে নিজ নিজ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে ফেরির সিরিয়াল পাওয়া, আবার অন্য রোড দিয়ে ঘুরে যাওয়াতে ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ত। এখন পদ্মা সেতুর কল্যাণে সময় আর খরচ দুটিই কমেছে।
সাব্বির নেওয়াজ