গ্যাস সংকটের পাশাপাশি লাগামছাড়া লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদনেও ধস নেমেছে। রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত, বিদেশি ক্রেতা হারানো ও জরিমানার আশঙ্কা করছেন শিল্প মালিকরা।
লোডশেডিংয়ের সময় যাঁরা নিজস্ব জেনারেটরে কারখানা চালাচ্ছেন, তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ব্যাপক। অধিকাংশ কারখানার শ্রমিকরা দিনের বড় অংশ অলস সময় কাটাচ্ছেন। বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কাঁচামাল। কমেছে শ্রমিকদের আয়। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল সোমবার দুপুরে টঙ্গীর হৃদি ফ্যাশন হাউজ নামে একটি পোশাক কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎ নেই। উৎপাদন বন্ধ। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই শ্রমিকরা কারখানার মেঝেতে বসে অলস সময় পার করছেন। টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভালুকা, ত্রিশালসহ দেশের শিল্পপ্রধান এলাকার অধিকাংশ কারখানায় গত দুই সপ্তাহে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। টঙ্গীতে প্রতিদিন তিন থেকে চারবার লোডশেডিং হচ্ছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কারখানা চালু রাখতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে জানান, অনেক গার্মেন্টস মালিক জানাচ্ছেন প্রতিদিন ১ লাখ টাকার বেশি ডিজেল কিনতে হচ্ছে। এতে তাঁদের খরচ কমপক্ষে ১০ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে।
শ্রমিকদের ওভারটাইম, নাইট করিয়ে উৎপাদনের সময় ঠিক রাখতে হচ্ছে। একদিকে গ্যাসের সংকটতো আছে; ফের বিদ্যুতের ঝামেলায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখা কঠিন হবে। একসময় শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে এসেছিলেন পোশাক কিনতে। চীন, ভিয়েতনামের বহু ক্রেতা এখনও বাংলাদেশমুখী। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যদি পণ্য সময়মতো সরবরাহ করা না যায়, তাহলে ক্রেতারা এদেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমন সংকটের মধ্যে গতকাল দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লোডশেডিং আরও বেড়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো সুখবর দিতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। দিন-রাত সমানে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। গভীর রাতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও বেড়েছে। এতে জনজীবনেও ভোগান্তি দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। রাতের বেলা সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা কমে। তবে প্রচণ্ড গরমের কারণে রাতে এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনেক কারখানা রাতে চালু রাখায় চাহিদা বেড়েছে। সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদার সময় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হয়। রাত ১১টার পর কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। ফলে উৎপাদন কমে লোডশেডিং বেড়ে যায়। গত কয়েক দিনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দিনের সবচেয়ে বেশি লোডশেড করা হচ্ছে রাত ১২টার পর। গত শুক্রবার সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে রাত ১টায় ২ হাজার ৫২৬ মেগাওয়াট। এদিন রাত ২টায় ২ হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট লোডশেড করা হয়। পরের দিন শনিবার সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ছিল রাত ১টায়, ৩ হাজার ৪১ মেগাওয়াট। রোববার রাত ১টায় লোডশেডিং ছিল ৩ হাজার ২৫ মেগাওয়াট, যা ওইদিনের সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে সোমবার দুপুর ১২টায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৯৯ মেগাওয়াট। ঘাটতি ২ হাজার ৬৭৫ মেগাওয়াট।
গাজীপুর
টঙ্গীর এসএম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার সহাকারী মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম বলেন, ৮ ঘণ্টা শ্রমিকরা কাজ করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় তাঁরা ৪ ঘণ্টাও কাজ করতে পারছেন না। গাজীপুরা শালিকচুরা এলাকায় কালার মার্ট প্রিন্টিংয়ের মহাব্যবস্থাপক এখলাসুর রহমান অভিযোগ করেন, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ৭০ ভাগে নেমেছে। গাজীপুরের ছোট-বড় অন্তত পাঁচ হাজার শিল্পকারখানা আছে। বেশির ভাগ কারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। লোকসানের মুখে পড়ছেন মালিকরা।
নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের নবান্ন ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্বাধিকারী ইকবাল আলী বলেন, আগে দিনে ১০০ টন গম ভাঙাতে পারতাম। এখন ৭০ বা ৮০ টন ভাঙাতে পারছি। শ্রমিক হামিদ মিয়া বলেন, মিলের প্রতি বস্তা আটা-ময়দার ডেলিভারি চার্জ ১০ টাকা। উৎপাদন কমায় তাঁদের আয়ও কমেছে। ফতুল্লার ওসমান গার্মেন্টসের মহাব্যবস্থাপক মঞ্জুর বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর চালু রাখতে দিনে ১ লাখ টাকার বেশি ডিজেল লাগে। ব্যবসা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুৎ সংকটের কারণে লবণ উৎপাদন ৫০ ভাগ কমে গেছে। এতে কোরবানির ঈদে গরুর খাবার থেকে শুরু করে চামড়া সংরক্ষণে লবণের সংকট তৈরি হতে পারে বলে জানালেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা।
আড়াইহাজারের মিথিলা টেক্সটাইলের পরিচালক মাহবুব খান হিমেল এ প্রতিবেদককে জানান, আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটের কারণে প্রতি তিনটি মেশিনের মধ্যে একটি মেশিন রোস্টার করে চালাতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু অর্ডার পেয়েও বায়ারদের ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান না হলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত চরম সংকটে পড়বে। অনতিদূরে বাতেন টেক্সটাইলের কারখানা। এখানে ৮২টি পাওয়ার লুম রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে ছয় হাজার পিস শাড়ি তৈরি হয়। এখন গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। এতে উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমেছে। এ অবস্থা আরও কিছু দিন থাকলে মিলটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৪০টি মেশিন নিয়ে আরও একটি কারখানা চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানাটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। মেশিনপত্র নষ্ট হচ্ছে।
মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মেঘনা স্টার কেবলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, তাঁরা প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের ফলে তাঁদের কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে। রপ্তানিতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
সাভার
গতকাল সোমবার দুপুরে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় সরেজমিন দেখা যায়, অধিকাংশ কারখানায় বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরের মাধ্যমে চলছে কারখানা। উলাইলের প্রাইড গ্রুপের একটি কারখানায় গিয়ে জানা গেল, বিদ্যুৎ এই আসে এই যায়। সাভারের রাজফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত গোল্ডেন স্টিসেস পোশাক কারখানায়ও একই চিত্র। বিদ্যুৎ সংকটে অধিকাংশ কারখানা বন্ধের ঝুঁকিতে। প্রচণ্ড গরমে শ্রমিকরা কাজ করতে চাচ্ছেন না।
ভালুকা ও ত্রিশাল
ভালুকা উপজেলায় বর্তমানে আড়াই শতাধিক উৎপাদনমুখী ছোট, মাঝারি ও বড় ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে। এই এলাকায় গ্যাস সরবরাহে সমস্যা থাকায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে উৎপাদন কমেছে ব্যাপকভাবে। ত্রিশালেও পরিস্থিতি নাজুক। কারখানায় নিজস্ব জেনারেটরে ডিজেল খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ত্রিশাল, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁ ও সাভার প্রতিনিধি