বর্ষা মৌসুমের আগেই রাস্তাঘাট সংস্কার করার জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন সংসদ সদস্যরা।
অনেক জায়গায় গ্রামীণ রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় কয়েকজন সংসদ সদস্যের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির দুটি বৈঠকে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দুটি বৈঠকে গ্রামীণ রাস্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সরকারি ও বিরোধী দলের চারজন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে একজন বলেছেন, বেহাল রাস্তার কারণে সংসদ সদস্যদের কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ওই কমিটিতে মোট সদস্য আছেন ১০ জন। যেসব সংসদ সদস্য গ্রামীণ রাস্তার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের দুজনের নির্বাচনী এলাকা গতকাল সোমবার ঘুরে কিছু রাস্তার খারাপ অবস্থা দেখা গেছে।
সামনে বর্ষা। এরপর জাতীয় নির্বাচন। বৃষ্টিতে ভাঙাচোরা রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ হবে। এর আগেই রাস্তাঘাট সংস্কার করার জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন সংসদ সদস্যরা।
দেশের সব উপজেলা সড়ক এবং ইউনিয়ন সড়কের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডির)। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সূত্র জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি ও ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এলজিইডির সড়ক নিয়ে আলোচনা হয়। গত ৩ মে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ৩০ মার্চের বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুমোদন করা হয়।
৩০ মার্চের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, কমিটির সদস্য বরিশাল–২ (উজিড়পুর–বানারীপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম বৈঠকে বলেন, এলাকার বেহাল রাস্তাঘাটের কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের গালিগালাজসহ নানা রকম কটূক্তি শুনতে হচ্ছে। কিন্তু এ রাস্তা তৈরি, মেরামত এবং সংস্কারকাজের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন। তাঁর নির্বাচনী এলাকার প্রায় ২০০–৩০০ কিলোমিটার রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে অনেক রাস্তার কাজ শুরু হয়েও থেমে যায়। তিনি বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই সব রাস্তা সংস্কার করার ব্যবস্থা নিতে বলেন।
এলজিইডি সূত্র জানায়, বরিশালের উজিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের অধীনে ৪৭৭টি সড়ক রয়েছে। সংস্কার না হওয়ায় প্রায় ৪০০টি সড়কের অবস্থা খারাপ। ২০০৭ সালে উজিরপুরের ওটরা ইউনিয়নের চেরাগ আলী থেকে হারতা ইউনিয়নের হারতা বাজার পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কটি কার্পেটিং করা হয়। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের আট কিলোমিটর খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। হাবিবপুর বাজারের পূর্ব পাশে প্রায় দুই কিলোমিটর সড়কে কার্পেটিং উঠে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
২০০১ সালে উজিরপুর থেকে সাতলা হয়ে হারতা সড়কের ২৬ কিলোমিটর কার্পেটিং করা হয়। সড়কটি সংস্কার না হওয়ায় কার্পেটিং উঠে গিয়ে কোথাও কোথাও কাঁচা সড়কের মতো হয়ে গেছে।
উজিরপুর স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী সুব্রত রায় বলেন, অধিকাংশ সড়ক সংস্কার না হওয়ায় চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। অথচ রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি কিলোমিটারে ৭৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। চেরাগ আলী থেকে হারতা রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে।
গঙ্গাচড়ার চিত্র
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান বলেন, গ্রামীণ বেহাল রাস্তার কারণে জনসাধারণের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। এ অবস্থায় তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে বিব্রতবোধ হয়।
অবশ্য গতকাল যোগাযোগ করা হলে মসিউর রহমান দাবি করেন, তিনি এ ধরনের কথা বলেননি। বৈঠকের কার্যবিবরণী তিনি খেয়াল করেননি। তাঁর নির্বাচনী এলাকার রাস্তা ভালো।
মসিউর রহমান রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য। গঙ্গাচড়া উপজেলা এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা নিয়ে তাঁর সংসদীয় আসন। গতকাল এই সংসদীয় এলাকার কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়কগুলো ছাড়া অন্য সড়কের অবস্থা ভালো নয়।
গঙ্গাচড়া উপজেলা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী মজিদুল ইসলাম বলেন, তাঁদের তিন ভাগের বেশি সড়ক কাঁচা। তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের রাস্তাগুলো পাকা করা সম্ভব নয়। তবে প্রধান সড়কগুলো ভালো। বিভিন্ন এলাকার সংযোগ সড়কগুলো পাকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আগের পরশুরাম ও উত্তম ইউনিয়ন এখন সিটি করপোরেশন এলাকাভুক্ত। চব্বিশহাজারি এলাকার লোকনাথ মন্দিরের পাশ থেকে বুড়িরহাট, কোবারু, বাহাদুরসিং, চব্বিশ হাজারি থেকে মৌবন ইটভাটা পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়কের কোথাও খোয়া উঠে গেছে। আবার কোথাও পিচের কার্পেটিং উঠে গেছে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আজম আলী বলেন, কিছু রাস্তার অবস্থা খারাপ। তবে এসব সড়ক প্রয়াত মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদের সময় প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ করা হলেও অসমাপ্ত ছিল। এখন নতুন করে প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা চলছে।
সংসদীয় কমিটির সূত্র জানায়, এলজিইডি সংসদীয় কমিটিকে জানায়, গ্রামীণ রাস্তা মেরামতের জন্য যে চাহিদা, তাতে ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। পাওয়া গেছে ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে উপজেলা সড়ক এবং পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মেরামতের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এসব কাজের ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়নের পর নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে কাজের গতি মন্থর হয়। তবে এখন কাজ চলছে।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও গ্রামীণ রাস্তাঘাটের মান নিয়ে আলোচনা হয়। কুমিল্লা–৪ আসনের (দেবীদ্বার) সংসদ সদস্য রাজি মোহাম্মদ ফখরুল বলেন, গ্রামীণ রাস্তাঘাটের রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা বেশ খারাপ। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। টাঙ্গাইল–৫ আসনের (সদর) সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে ঠিকাদারেরা এখন দায়সারাভাবে কাজ করছেন। ভিত শক্ত না হওয়ায় গ্রামীণ রাস্তাগুলো তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে বলেন, গ্রামীণ রাস্তাগুলো হালকা যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ রাস্তাগুলো দিয়ে ভারী যানবাহনও চলাচল করছে। এর ফলে রাস্তা দ্রুত খারাপ হচ্ছে। এ জন্য ভার বহনের ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে রাস্তার কাঠামোগত নকশা নতুনভাবে করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আরিফুল হক, রংপুর এবং জহুরুল ইসলাম, গৌরনদী, বরিশাল)