গাছের একটি পাতা ছিঁড়লেও গাছ টের পায়, ব্যথা পায়। অথচ একটি কিশোরীকে স্কুল থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হলো; সমাজ নামের বৃক্ষের অন্য পাতাগুলো নড়ল না! গরিব ঘরের মেয়ে বলেই কি?
মুক্তি রানী আর নেই। কিশোরী মেয়েটা আর স্কুলে যাবে না। মনের গোপন কথাগুলো বড় বোনকে চুপিচুপি বলবে না। বাবার কাছে আবদার করবে না। মায়ের কাছে বকা খাবে না। সে নেই, কিন্তু তার ছবি আছে। সেই ছবিটি গরিব ঘরের বেড়ার দেয়ালে ঝুলে থাকবে। তার জন্য শোকসভা হবে না। কিন্তু দেয়ালের ওই ছবিটা বাড়িটাতে সার্বক্ষণিক শোকের আবহ ছড়িয়ে যাবে। অকালে নিহত হওয়া এক স্বপ্নের বেদনা ফ্রেমবন্দি হয়ে পরিবারটিকে দুঃখ দিয়ে যাবে।
কিশোরীটিকে হত্যা করা হয়েছে। কে করেছে? সহজ উত্তর। এক বখাটে কাউসার। বিভিন্ন পরিচয়ের কাউসারকে পাওয়া যাবে। কেউ কোনো নেতার ভাতিজা, কেউ দলের ক্যাডার, কেউ মাফিয়াতন্ত্রের শাখা কিশোর গ্যাংয়ের জুনিয়র ‘বস’। তারা কিশোরীদের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে শিয়ালের মতো ওত পাতে। তাদের জীবনটা অতিষ্ঠ করে ফেলে।
এ বছরের দুটি ঘটনা জানাই। ২৫ ফেব্রুয়ারিতে হবিগঞ্জের মাধবপুরে কিশোর গ্যাং সদস্যদের অত্যাচার সইতে না পেরে মাসুমা (১৪) নামে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরী বিষ খেয়ে মরে গেছে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে জামালপুরের মেলান্দহে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে চেয়ারম্যানের ভাতিজা। মেয়েটি তার মাকে হৃদয়বিদারক চিঠি লিখে আত্মহত্যা করে। বরগুনার তালতলীতে এক কিশোরীর ব্যক্তিগত ভিডিও ছড়িয়ে দেয় এক বখাটে। লজ্জায় মেয়েটির মা আত্মহত্যা করেন। পত্রিকা খুলে দেখুন, গুগল করে দেখুন; এমন ঘটনা আকসার ঘটছে।
নারীর চোখে দুনিয়া দেখতে পারলে দেখা যেত, এক দল হিংস্র নারী-শিকারি শিয়াল শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা একে বলে ‘মুরগি’ ধরা। অল্প বয়সী মেয়েরা এইসব শিয়ালের চোখে মুরগির মতো। মেয়ের মা হয়ে দেখুন, কিশোরী-তরুণীকে কী রকম পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। বাবা হয়ে দেখুন, কন্যাসন্তানকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তায় দিন কাটে।
ধনীর দুলাল থেকে শুরু করে বখাটে কিশোর গ্যাং সমাজটাকে অনিরাপদ করে রেখেছে। এইসব ধর্ষক, নারী নির্যাতক একা নয়। এসব শুধু পুরুষালি ক্ষমতার কাজ না। এর সঙ্গে লাগে দলের ক্ষমতা বা টাকার ক্ষমতা বা প্রশাসনিক খুঁটির জোর। ক্ষমতাধরদের মদদ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের দাপট তৈরি হতে পারে না। ক্ষমতার এই বিকারকে শায়েস্তা না করতে পারলে মুক্তি রানী বর্মনরা বাঁচবে না; বাংলাদেশ শান্তি পাবে না। গ্রাম-মফস্বলে ঘুরে দেখেছি; রাস্তার পাশে, ঝোপের ভেতর অজস্র বাঁশের মাচা তৈরি হয়েছে। তরুণরা সেখানে বসে তাস খেলে, মাদক নেয়; মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘নীল-ধ্যান’ করে। দল বেঁধে মোটরসাইকেল হাঁকায়। মেয়েদের পিছু লাগে।
আমাদের ছোটবেলায় যে কিশোর গ্যাংটি হিরো হয়ে উঠেছিল, তার নাম ‘তিন গোয়েন্দা’। সেবা প্রকাশনীর গোয়েন্দা সিরিজের তিন নায়কের গল্প। আমরা সেই কিশোর, মুসা ও রবিনের মতো হতে চাইতাম। আর এখনকার কিশোর চক্রগুলো হয়ে উঠেছে মাফিয়াতন্ত্রের ছোট তরফের অংশীদার। অনেক কিশোর-তরুণের বখাটে শিয়ালে রূপান্তরিত হওয়া আর বাংলাদেশে মাফিয়াতন্ত্রের বিস্তার একই তালে ঘটেছে। মাফিয়া নেতা, মাদক কারবারি ইত্যাদির দরকার অনুগত পদাতিক খুদে মাস্তান। অন্যদিকে সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্রের প্রতি হতাশ কিশোরদের দরকার ছিল ‘ব্যাটা’ হয়ে ওঠার সুযোগ; যেখানে অস্ত্র থাকবে, নেশা থাকবে, টাকা থাকবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাংগুলোর ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এই বক্তব্য সমর্থন করে। দেখা যায়, এলাকার রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা তাদের মাদক ও দাপটের কারবারে কিশোর গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে বিদেশি চলচ্চিত্র, ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুক রিল মিলিয়ে যৌন বিকারের ঝড় বইছে। ভারতীয় রিয়েলিটি শোগুলোতে শিশুদেরও যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া গান ও নাচের ‘আইটেম’ বানানো দেখতে শিখেছি আমরা। সংস্কৃতির এই অসুস্থ যৌনায়নের প্রভাব পড়বে না সমাজে? এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দাপুটে ছাত্র-যুব সংগঠনের পুরুষদের হিংস্র যৌন চাহিদা মেটানোর গোপন এন্তেজাম। অপরাধ ও সহিংসতার যে সামাজিক জলবায়ু ছিল; অল্প বয়সীদের অপরাধপ্রবণতা তারই অশান্ত বর্ণালি। এটা এক প্রজন্মগত সমস্যা। এর সঙ্গে জড়িত মাফিয়া রাজনীতি, মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাস এবং ব্যাটাগিরি সংস্কৃতি। কিন্তু এসব কারণ বাদ দিয়ে একজন-দু’জনকে ‘তুই অপরাধী রে’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে কেবল পুলিশি সমাধানের ঝোঁক দেখা যায়। সমস্যার কারণ তাতে দূর হবে না।
সমাজে যদি বল প্রয়োগের দাপট থাকে, বিনা বিচারে শাস্তিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয়, এলাকার দাপট ধরে রাখতে কিশোর মাস্তান বাহিনী তৈরি রাখা হয়, অসুস্থ যৌনতার বিপ্লব বইয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মুক্তি রানীর মতো মেয়েরা চূড়ান্ত অনিরাপদ হয়ে পড়তে থাকবে। শহরের চাইতে গ্রামের পরিস্থিতি আরও মারাত্মক। এ রকম অবস্থাতেই গ্রামীণ অভিভাবকরা মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হন।
তাই নিজের ছেলেকে বখাটে করতে না চাইলে; মেয়েটিকে নিরাপদ কৈশোর দিতে চাইলে মাফিয়াতন্ত্রের দিকে আঙুল তুলতেই হবে। কিন্তু সেটাই শেষ না। স্কুল-কলেজের পরিবেশকে সবার জন্য আনন্দময় করতে হবে। পড়ালেখার বাইরের রোমাঞ্চকর ও শিক্ষণীয় আনন্দের কাজে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখতে হবে। শিক্ষার মধ্যে নারীকে সম্মান করা এবং নিজেকে সম্মানিত রাখার চেতনা পুরে দিতে হবে।
একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটির কথা ফুটবল সমঝদারমাত্রই জানেন। ম্যানচেস্টার শিল্পশ্রমিকের শহর। ১৯ শতকের মাঝামাঝি এই শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর মারামারি আর ছোরা-সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যায়। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ একটা বুদ্ধি করলেন। শহরজুড়ে ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। গরম রক্ত সুস্থ খাতে বয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে তরুণরা মাস্তানি ছাড়ল। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সেই সময়েই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস।
আধুনিক সময়ে ব্রাজিল ও কলম্বিয়া এই কৌশল নিয়ে সফল হয়েছে। মাস্তানপ্রবণ এলাকায় ফুটবল ক্লাব গড়ে দেওয়ার পর দেখা যায়, অপরাধ কমে গেছে। সমাজ-রাষ্ট্রের অভিভাবকদের যদি টনক বলে কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা জরুরিভাবে এখনই নড়া উচিত।
ফারুক ওয়াসিফ: পরিকল্পনা সম্পাদক, সমকাল; লেখক
farukwasif0@gmail.com