দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে অবস্থান জানাল ঢাকা

0
128
বাংলাদেশ-জাপান

বাংলাদেশ-জাপান যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে টেকসই সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এদিকে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানও স্পষ্ট করেছে ঢাকা। গত বুধবার টোকিওতে বাংলাদেশ ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর গতকাল বৃহস্পতিবার এই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। ১১ পৃষ্ঠার এই যৌথ বিবৃতিতে ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এতে রোহিঙ্গা সংকট, চীন সাগর প্রসঙ্গ, বৈশ্বিক নানা বিষয় উঠে এসেছে।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বৈরিতা বহু দিনের। এ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কখনোই পরিষ্কার ছিল না। তবে এবার দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাল ঢাকা। এ সাগরে জাতিসংঘের সমুদ্রবিষয়ক আইন ১৯৮২-এর আনক্লজ সমর্থন করা এবং এখানকার যে অবস্থা রয়েছে তা একতরফাভাবে জোরপূর্বক বা বল প্রয়োগ করে পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে এ কার্যক্রমের কারণে উত্তেজনা বাড়লে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে– তাও অগ্রহণযোগ্য।

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ
বাসস জানায়, যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী  ফুমিও কিশিদা একমত হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী বাস্তুচ্যুতি আশ্রয়দাতা কমিউনিটির ওপর চাপ বাড়াবে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। দুই নেতা এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য একটি ‘টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।

শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য এই বাস্তুচ্যুতির মূল কারণগুলোর সমাধান করে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন।

তিনি ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে প্রথম দেশ হিসেবে জাপানের মানবিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী কিশিদা তাদের প্রতি জাপানের ক্রমাগত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে ভাসানচরসহ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী ও বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাবাসনের পর তাদের স্বনির্ভর জীবনের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণের মতো উপযুক্ত সহায়তা প্রদানের গুরুত্বের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী কিশিদা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত ও স্কুলে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য জাপানে শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান।

দুই প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের সংকট সমাধানের জন্য আসিয়ানের প্রচেষ্টার প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এ ব্যাপারে তাঁরা আসিয়ান চেয়ারের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমারের পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত নানাবিধ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। তাঁরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। কিশিদা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের অব্যাহত মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

চীন সাগর ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী পূর্ব এবং দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। এ সময় দুই প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সমুদ্রবিষয়ক আইন ১৯৮২-এর আনক্লজ সম্পূর্ণ মেনে চলার বিষয়ে তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা জানান। এ সময়ে বেসামরিক বিমান চলাচলের নিরাপত্তার খাতিরে সকল স্থানে চলাচলের স্বাধীনতার গুরুত্বের বিষয়টি আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আইকাও’র আইন অনুসরণে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ভঙ্গ করে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইল কার্যক্রম নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সম্পূর্ণ মেনে চলতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে গুম এবং মানবিক বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে উদ্বেগ রয়েছে তা আমলে নিতে আহ্বান জানান তাঁরা।

বিবৃতিতে বলা হয়, জাপানের সামরিক জাহাজ জেএমএসডিএফ-এর চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙরের বিষয়ে আলোচনা করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে করা সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী অভিন্ন স্বার্থে নিরাপত্তা সহযোগিতার আওতায় সামরিক জাহাজ ও উড়োজাহাজের সফর, বিভিন্ন বাহিনীর সফর বিনিময় এবং প্রশিক্ষণের মতো বিষয় এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়। দুই দেশের দূতাবাসে প্রতিরক্ষা শাখা খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে প্রতিরক্ষা ও কূটনীতিতে আলোচনার বিষয়ে মতৈক্য হয়। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম নিয়ে চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুকে স্বাগত জানান দুই প্রধানমন্ত্রী।
যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসনের ভিত্তিতে বহুপাক্ষিকতার প্রতি তাঁদের সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রাথমিক সংস্কারসহ জাতিসংঘকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তাদের দৃঢ়সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী কিশিদা জাপানের স্থায়ী সদস্য হওয়াসহ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারে ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কিশিদা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্যদের সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি ২০২২ সালের জন্য জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর সক্ষমতার প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ‘পিস বিল্ডিং সেন্টার’-এর সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

দুই প্রধানমন্ত্রী শান্তি সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছেন। উভয় নেতাই পারমাণবিক অস্ত্রহীন বিশ্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
এ সময় দুই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ও তাদের অর্থায়ন ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়াও তাঁরা সন্ত্রাসীদের আন্তঃসীমান্ত চলাচল বন্ধের ওপরও জোর দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরুল্লেখ করেন যে, তাঁর সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন, সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করছে। তাঁর সরকার সাধারণ মানুষের কার্যকরী অংশগ্রহণের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্কগুলো থামাতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কিশিদা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বাস্তবায়িত প্রকল্প ও জাপানি ব্যবসায় কর্মরত জাপানিসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল জাপানি নাগরিকের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.