ঘর হারিয়ে নির্ঘুম রাত, জোটেনি খাবার

0
134
ঘর হারিয়ে ত্রিপলে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক রোহিঙ্গা।

সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন রোহিঙ্গা নারী শামসুন্নাহার (৪০)। এর পর তাঁদের আশ্রয় হয় কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে। সেখানে একটি ঘরে সন্তানদের নিয়ে বাস করছিলেন তিনি। রোববার আগুনে পুড়ে সেই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও ছাই হয়ে গেছে। পরদিন সকালে ধ্বংসস্তূপের কিছুটা দূরে ত্রিপলের ছাউনি টানিয়ে সন্তানদের নিয়ে বসেছিলেন শামসুন্নাহার। চেহারায় ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তার ছাপ।

তিনি বলেন, আগুন লাগার পর সবাই প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছাড়েন। কেউ কোনো কিছু নিতে পারেননি; সব পুড়ে গেছে। রাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত খাবার পড়েনি কারও পেটে। সবাই রাত কাটিয়েছেন নির্ঘুম।

একইভাবে খোলা জায়গায় চার সন্তান নিয়ে অবস্থান করছেন আমেনা খাতুন (৩৬)। তাঁর স্বামী আবুল কালাম পুড়ে যাওয়া ঘরের ভেতর খুঁজে দেখছেন কোনো কিছু ব্যবহারের উপযোগী আছে কিনা। আমেনা খাতুন বলেন, সবকিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল। গভীর রাত পর্যন্ত কেউ ধ্বংসস্তূপের দিকে যেতে পারেননি। কিছুক্ষণ পরপর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হচ্ছিল। সবাই আবার নিঃস্ব হয়ে গেল।

উখিয়া বালুখলী ১০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোববার বিকেলের আগুনে প্রায় ২ হাজার ঘর পুড়ে গেছে। এর ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন ১২ হাজার মানুষ। বর্তমানে তাঁদের অনেকেই শামসুন্নাহার ও আমেনা খাতুনের মতো খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। সেখানে খাবার ও পানির সংকট চলছে। ধ্বংসস্তূপে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র ও আসবাব খুঁজছেন কেউ কেউ। কেউ আবার নিজের ঘরের অবস্থান চিহ্নিত করে খুঁটি পুঁতে রাখছেন।

রোহিঙ্গারা জানান, এদিন বিকেল ৩টায় প্রথমে ১১ নম্বর ক্যাম্পের ‘বি’ ও ‘ই’ ব্লকে আগুন লাগে। পরে পার্শ্ববর্তী ১০ ও ৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথক জায়গায় একসঙ্গে আগুন জ্বলতে দেখেন তাঁরা। প্রচণ্ড গরম ও উত্তর দিক থেকে ছুটে আসা বাতাসে মুহূর্তে অন্য বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ঘরগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো ও ঘনবসতি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, পুড়ে যাওয়া ২ হাজার ঘরের মধ্যে শতাধিক দোকান, ৩৫টি মসজিদ-মক্তব, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যুবকেন্দ্র, রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদান কেন্দ্র, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ও মানসিক পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে।

কক্সবাজারের আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডে গৃহহীন রোহিঙ্গাদের সোমবার সকাল থেকে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম আশ্রয়হীনদের জন্য অস্থায়ী ঘর তৈরি করবে। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা- ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। ঘটনাস্থলে ৫টি মেডিকেল টিম রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। সেখানে ৯০ জন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। অগ্নিকাণ্ডে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হচ্ছে। কেউ নিখোঁজ কিংবা হতাহত হননি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস, এপিবিএন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা সদস্য রয়েছেন।

আবু সুফিয়ান বলেন, সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে এ কমিটি। তিন দিনের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে ২২২টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। সর্বশেষ রোববার বালুখালী ক্যাম্পে আগুন লেগেছে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ক্যাম্পে বারবার অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নাশকতামূলক তৎপরতা থাকতে পারে। ফলে সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, আগুন লাগার পর পালানোর চেষ্টাকালে এক যুবককে আটক করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর হেফাজতে রাখা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে অন্য কারণ আছে কিনা, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.