রাজাকারের তালিকা তৈরির জন্য গত এপ্রিলে তিন সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। উপকমিটির সভাপতি শাজাহান খান। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। উপকমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ।
উপকমিটিকে রাজাকারের একটি নির্ভুল তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলায় জেলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে রাজাকারের তালিকা করে তা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) পাঠানোর কথা উপকমিটির।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এই উপকমিটি চারটি বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে রাজাকারের তালিকা তৈরিতে কী কী করা যেতে পারে, তার উপায় খোঁজা হয়েছে। তালিকা করতে গিয়ে কী ধরনের বাধা আসতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
রাজাকারের তালিকা তৈরির সবশেষ অবস্থা জানতে উপকমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তিনজনই বলছেন, রাজাকারের তালিকা তৈরি করা কঠিন। দেশ স্বাধীনের এত বছর পর রাজাকারের তালিকা করতে গিয়ে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। সে কারণে তালিকা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের ৫২ বছরে বহু রাজাকার বিভিন্ন জনের আত্মীয় হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে সত্য কথা বলবেন না। আবার অনেকে শত্রুতা করে কাউকে রাজাকার বানানোর চেষ্টা করতে পারেন। মাঠপর্যায়ে এমন অবস্থা হতে পারে। তাই সচেতনভাবে খুব সুচিন্তিতভাবে তালিকা তৈরির কাজটি করতে হবে, যাতে কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা প্রকাশের পর দেশজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। কারণ, রাজাকারের তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নামও উঠে আসে। শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও তালিকায় পাওয়া যায়। এ নিয়ে সংসদে তোপের মুখে পড়েন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। পরে সেই তালিকা স্থগিত করা হয়।
তালিকা করা নিয়ে জটিলতা
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, রাজাকারের তালিকা করার ক্ষেত্রে আগে আইনগত সুযোগ ছিল না। পরে সরকার পুরোনো আইন বাতিল করে। নতুন করে জামুকা আইন তৈরি করে। জামুকাকে রাজাকারের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জামুকা আইনের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। গত আগস্টে আইনটি সংসদে পাস হয়।
রাজাকারের তালিকা তৈরির জন্য গঠিত উপকমিটির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলছেন, এই তালিকা তৈরির কাজটি বেশ জটিল। তবে ইতিমধ্যে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু মাঠে কাজ করতে গিয়ে অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ, পাঁচ দশক আগের ঘটনা। অনেকে শত্রুতা করে কারও নাম দিতে পারে। সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হচ্ছে। আবার অনেকে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে। এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
অবশ্য ভিন্নকথা বলছেন উপকমিটির সদস্য তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা তৈরিতে তেমন অগ্রগতি নেই। তালিকা তৈরিতে জেলায় জেলায় যেতে হবে। আমি এখনো কোনো জেলায় যেতে পারিনি। স্বাধীনতার এত বছর পর গ্রামের অনগ্রসর মানুষ আরেকজন সম্পর্কে তথ্য দিতে চাইবে না। কাজটি জটিল, তবে অসম্ভব নয়।’
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। ৫২ বছর পর এসে আর কাউকে নতুন করে তালিকায় ঢোকানোর সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাঁর নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তের সুযোগ নেই। নতুন করে কাউকে ভাতা দেওয়া হবে না। তবে তালিকা থেকে যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁরা চাইলে আপিল করতে পারবেন। তালিকায় যদি ভুয়া কারও নাম এসে থাকে, তা বাতিল করা হবে।
অন্যদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় নতুন করে প্রায় দেশ শতাধিক নাম যুক্ত করার আভাস মিলেছে। ২৭ ডিসেম্বর এ নিয়ে বৈঠক ডেকেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত দুই ধাপে ৩৩৪ জনকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় যুক্ত করে তাঁদের নামে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা করেছি। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, যদি কেউ দৃষ্টিগোচর করে, সেটা তদন্ত করে দেখব। যদি কোনো নন-মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়ে থাকেন, আমরা আবার যাচাই করব। তিনি যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হন, তাহলে তাঁর গেজেট বাতিল করা হবে।’