শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে দেশের ১৫ হাজার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বই কিনবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকার বই কেনা হবে। এ জন্য ৯৬টি বইয়ের তালিকা চূড়ান্ত করেছে এ–সংক্রান্ত কমিটি। তবে এর মধ্যে ১৩টি বই নিয়ে নানা রকম আপত্তি উঠেছে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রকাশকদের একাংশের দাবি, বইয়ের তালিকা তৈরিতে অনিয়ম হয়েছে।
সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইডিপি) আওতায় ‘স্ট্রেনদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ শীর্ষক স্কিমের আওতায় এসব বই কেনা হবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বইয়ের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর থেকে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন অনেক প্রকাশক। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, তালিকা তৈরিতে কোনো অনিয়ম হয়নি।
বইয়ের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৯৬টির মধ্যে ৭টি বইয়ের প্রকাশনীর নামের গরমিল আছে। ইংরেজি তিনটি বইয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। দুটি বই আছে বিতর্কিত লেখকের। একটি বইয়ের স্বত্ব নিয়ে রয়েছে অভিযোগ।
এসইডিপি প্রকল্পের উপপরিচালক আছিছুল আহছান কবীর বলেন, ‘বইয়ের জন্য যে প্রকাশনীর নাম উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেই আমাদের কিনতে হবে। নির্দিষ্ট প্রকাশনীতে সেই বই পাওয়া না গেলে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
তালিকার পর্যালোচনা
এসব বই কেনার জন্য ২০২০ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করে মাউশি। ২০২১ সালের মে মাসে আহ্বান করা হয় দরপত্র। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত হয় তালিকা। এসইডিপির মূল প্রকল্প ৩০০ কোটি টাকার বেশি। আগামী অর্থবছরেও এ প্রকল্প চলমান থাকার কথা।
প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য বই কেনা হবে ২০টি করে। দশম শ্রেণির জন্য ১৬টি করে বই কেনা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস, বঙ্গবন্ধু কিশোর গল্প, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, ছড়া, কবিতার উল্লেখযোগ্য বই নিয়ে তালিকা হয়েছে। তবে অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত আলী আসগরের লেখা ‘পৃথিবী’ নামের বইটির প্রকাশকের নাম তালিকায় দেওয়া আদিত্য প্রকাশ। অথচ বইটি অনিন্দ্য থেকে প্রকাশিত। বুলবুল চৌধুরীর ‘নির্বাচিত কিশোর গল্প’ বইটি তালিকাভুক্ত হয়েছে রাবেয়া বুক হাউজের নামে; তবে বইটি হাতেখড়ি থেকে প্রকাশিত। সপ্তম শ্রেণির মাহমুদ আল জামানের ‘জসীমউদ্দীন’ বইয়ের প্রকাশনা জল রঙ প্রকাশন উল্লেখ থাকলেও সেটি শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
বন্দে আলী মিয়ার ‘ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ আশীর্বাদ প্রকাশনীর নামে তালিকাভুক্ত হলেও মূল প্রকাশক সাহিত্যমালা। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠতালিকায় অন্তর্ভুক্ত শরীফ খানের ‘ছোটদের পাখি ও বন্যপ্রাণী’ বাইটি অরিত্র প্রকাশনীর। দিব্য প্রকাশের একজন কর্মচারীর নামে এই প্রকাশনীর বাণিজ্য সনদ নেওয়া হয়েছে। বই কেনার তালিকায় দিব্য প্রকাশের অন্যান্য বইও রয়েছে। একই শ্রেণির জন্য নির্বাচিত ‘এইতো আমার দেশ’ বইটি ঝিঙেফুল থেকে প্রকাশিত হলেও তালিকায় আছে মজিদ পাবলিকেশনের নাম। নবম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত মমতাজউদদীন আহমদের ‘সজল তোমার ঠিকানা’ বইটি রাফাত পাবলিকেশনস নামে তালিকাভুক্ত। এটি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত। দশম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত দ্বিজেন শর্মার ‘নিসর্গ কথা’ বইটির প্রকাশক আদিত্য প্রকাশ বলা হলেও এটি অনিন্দ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণির জন্য তিনটি ইংরেজি বই নির্বাচন করা হয়েছে। বই তিনটি হচ্ছে ‘রিপ ভ্যান উইংকেল’, ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এবং ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেইজ’। বইগুলো কোন প্রকাশনীর, তা উল্লেখ নেই তালিকায়।
নীতিমালায় বলা আছে, ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে বাংলা উচ্চারণ ও শব্দার্থসমন্বিত বই নির্বাচন করতে হবে। এ ছাড়া দরপত্রের প্রতিটি ঘর পূরণ করে বই জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে বিজ্ঞপ্তিতে। এ বইগুলোর ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। সপ্তম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কু’ বইটি নওরোজ কিতাবস্তান থেকে প্রকাশিত। কিন্তু এটি চিরায়ত বই নয় বলে এর গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বই সংগ্রহের নীতিমালার ১৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে—‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কোনো লেখকের গ্রন্থ নির্বাচন করা হবে না।’
তালিকায় ‘লেবুমামার সপ্তকাণ্ড’ ও ‘বীরবলের খোশগল্প’ বই দুটির লেখক মোহাম্মদ নাসির আলী। বাংলা একাডেমির চরিতাভিধানে মোহাম্মদ নাসির আলী সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রেডিওর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তবে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের বিরোধিতা করা ৫৫ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় মোহাম্মদ নাসির আলীর নাম নেই।
আদালতে রিট
নাসির আলীর বই তালিকাভুক্ত হওয়ায় নীতিমালার ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন চার প্রকাশক। তাঁদের একজন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. কায়সার-ই আলম প্রধান। তিনি বলেন, ‘সব প্রকাশনী থেকে একটি করে বই তালিকায় স্থান পেলে করোনাকালে প্রকাশকদের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও কাটত। ৯৬টির মধ্যে ১৭টি বই মাত্র চারটি প্রকাশনীর—কাকলী প্রকাশনী, আগামী, সময় ও আদিত্য। অন্য বইগুলোর প্রকাশকের খবর নিয়ে দেখেন তাদেরই (চার প্রকাশনীর) আত্মীয়স্বজনের নামে লাইসেন্স নেওয়া। অধিকাংশ বই তাদেরই সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। প্রকল্পের টাকায় সুফল পাচ্ছেন গুটিকয় প্রকাশক। না বোঝার কোনো কারণ নেই যে এখানে বড় দুর্নীতি হচ্ছে।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন মাউশির তালিকায় বই থাকা প্রকাশকেরা। আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বলেন, ‘বই কেনার তালিকা হলেই নানা অভিযোগে তা বানচাল করার চেষ্টা করা হয়। যথাযথভাবে কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। সবাই মিলে মানসম্পন্ন বইয়ের তালিকা করেছে। তারা প্রমাণ করুক যে এখানে মানহীন বই আছে।’
চার প্রকাশকের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ মে আদালত রুল জারি করেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, এসইডিপি প্রকল্পের বই কেনার তালিকার নীতিমালার ১৭ নম্বর ধারা পরিপন্থী দুটি বই আছে। বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান এবং মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ এ কাজটি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, উল্লেখ করে ছয় সপ্তাহের রুল জারি করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এসইডিপি প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব, উন্নয়ন) বেলায়েত হোসেন তালুকদার বলেন, ‘বইয়ের তালিকা নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’