সুন্দরবন রক্ষায় কী করছে বন বিভাগ
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগ থেকে রাজস্ব আহরণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করেছে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।
জানতে চাইলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সরকার চায় রাজস্ব বৃদ্ধি পাক। সেই হিসেবে বৃহৎ এই সুন্দরবনের গুটিকয়েক কয়েক খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। তবে পুরো সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা রয়েছে সংরক্ষিত। ওই এলাকাগুলো রয়েছে রাজস্ব আহরণের বাইরে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ করতে গিয়ে বনের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না।
শুধু রাজস্ব আহরণের ব্যাপারটি মুখ্য নয় উল্লেখ করে মিহির কুমার দো বলেন, এর সঙ্গে সুন্দরবনসংলগ্ন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা জড়িত।
গাছ কেটে নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্র
সুন্দরবনের ভেতরে বর্তমানে আটটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে বছরে প্রায় দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। ওই পর্যটনকেন্দ্রগুলো হলো পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী ও দুবলার চর। আর পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল), কলাগাছী ও কাগা দোবেকী। এসব স্থানে ভ্রমণ করা পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশ্চিম বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ভ্রমণে গেছেন ৫৯ হাজার ৯১৫ জন। এ থেকে রাজস্ব এসেছে ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেছেন ৭৩ হাজার ৬১৩ জন। রাজস্ব উঠেছে ৭৬ লাখ ১৯ হাজার ৪৭০ টাকা।
অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ পর্যটন থেকে রাজস্ব পেয়েছে ৬৭ লাখ ৬ হাজার ৫৭৬ টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব পেয়েছে ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
এই পর্যটনকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি নতুন করে তিনটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরি করছে বন বিভাগ। এগুলো হচ্ছে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী এলাকায় এবং শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিকে। এসব পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে আশপাশের বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা পড়েছে। বনের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে কংক্রিটের স্থাপনা। এতে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সম্প্রতি খুলনা রেঞ্জের নির্মাণাধীন কালাবগী ও শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, পর্যটকদের জন্য কেন্দ্র দুটিকে বনের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের ওয়াকওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার। আছে টিকিট কাউন্টার, বাথরুম ও বিশ্রামের জায়গা। এসব কাজ করতে কাটা হয়েছে বিপুল পরিমাণ গাছ।
জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, তাঁরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পর্যটকদের আনাগোনা কমিয়ে আনতে চান। প্রতিবছর যে পরিমাণ পর্যটক ওইসব এলাকায় ভ্রমণ করেন, তা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু পর্যটক তো আর কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ কারণে বনের শুরুর এলাকাগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র করা হয়েছে। এতে বনের ভেতরের অংশে মানুষের চাপ কমবে। এ ছাড়া যে অংশটুকু নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র করা হয়েছে, সেটি বনের বিবেচনায় খুবই ক্ষুদ্র অংশ।
নেই ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা
সুন্দরবন সাধারণত পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান) আওতায়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওই পরিকল্পনা হয় ১০ বছর মেয়াদি। সবশেষ ২০২০ সালে ওই পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর দুই বছর কেটে গেলেও নতুন করে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি।
বন কর্মকর্তারা বলছেন, ওই পরিকল্পনার আওতায় সুন্দরবনে কখন, কোথায় কী কাজ করা হবে, তার বর্ণনা থাকে। কিন্তু বর্তমানে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় ভবিষ্যতে সুন্দরবন নিয়ে কী ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজন, তা তাঁরা জানতে পারছেন না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক মো. নাজমুস সাদাত বলেন, বনের ক্ষতির জন্য যেসব হুমকি আছে, সেগুলো মোকাবিলায় সবার আগে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ বন বিভাগের ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর পাশাপাশি সুন্দরবনে পর্যটক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা দরকার।
বন বিভাগের যত পদক্ষেপ
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বন বিভাগ। এর মধ্যে গাছ পাচার রোধ ও বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী নিধন ঠেকাতে ‘স্মার্ট প্যাট্রল টিম’ গঠন অন্যতম। বন্য প্রাণীর স্বাদুপানির চাহিদা মেটাতে বনের মধ্যে থাকা ৮০টি পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। নতুন করে খনন করা হচ্ছে পাঁচটি পুকুর। জোয়ারের পানির হাত থেকে বন্য প্রাণীকে রক্ষার জন্য বনের মধ্যে ১২টি উঁচু মাটির কেল্লা তৈরি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ঠিক আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য ইকোলজিক্যাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। প্রতিবছর তিন মাস (জুন-আগস্ট) বন্ধ করা হয়েছে সুন্দরবন থেকে সব ধরনের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম।
বন কর্মকর্তারা জানান, বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষকে সচেতন করতে নিয়মিত উঠান বৈঠক, কীটনাশক প্রয়োগকারী ও হরিণশিকারিদের ধরিয়ে দিতে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেছে বন বিভাগ।