সুন্দরবনে ৮ নদীতে দিনে চলছে ৩৪৫ জাহাজ

0
60
সুন্দরবনের মধ্যে পশুরসহ আটটি নদী দিয়ে চলাচল করছে দেশি-বিদেশি হাজারো জাহাজ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মধ্যে পশুরসহ আটটি নদী দিয়ে চলাচল করছে দেশি-বিদেশি হাজারো জাহাজ। প্রতিদিন চলছে গড়ে ৩৪৫টি। এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের নদী, মাটি, গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর ওপর। এ প্রভাব কতটা ভয়াবহ তা নিরূপণে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ হলেও এখনও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা। ক্ষতি নিরসনেও নেওয়া হয়নি কার্যকর উদ্যোগ। এতে হুমকিতে পড়ছে গোটা বনের জীববৈচিত্র্য।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে প্রায় ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ পশুর নদ দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। ৭০ বছর ধরে এই রুটে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার জাহাজ ১৯৭২ সাল থেকে মোংলা হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে থাকা কালিঞ্চি, রায়মঙ্গল, কাচিকাটা, আড়পাঙ্গাসিয়া, বজবজা, আড়ুয়া শিবসা, শিবসা ও পশুর নদ দিয়ে ভারতে যাওয়া-আসা করে। অন্য সাত নদী দিয়ে জাহাজ চলাচল করে ৫২ বছর ধরে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, পশুর নদ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চলাচল করে দেশি-বিদেশি ২২৫টি জাহাজ। অন্য সাতটি নদীতে প্রতিদিন এ সংখ্যা গড়ে ১২০। এ দুটি রুটের জাহাজে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার, ফ্লাইঅ্যাশ, কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পাথর, এলপি গ্যাস, খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য থাকে।

সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, জাহাজগুলো থেকে নিঃসৃত তেল ও অন্যান্য বর্জ্য বনের পানি ও মাটিতে দূষণ ঘটায়। জাহাজের ঢেউয়ের কারণে তীর ভেঙে পলি পড়ে নদীর নাব্য কমে যায়। জাহাজের শব্দ এবং রাতে আলো বন্যপ্রাণীদের আতঙ্কিত করে তোলে। বনের মধ্যে নদীতীরে এখন আর আগের মতো বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখা যায় না।

বন বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বনের মধ্যে নদীতে গত ৯ বছরে কয়লা, সার, ফার্নেস অয়েল, ক্লিংকার, ফ্লাইঅ্যাশসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে অন্তত ২৬টি জাহাজ ডুবে গেছে। জাহাজে থাকা ফার্নেস অয়েল, কয়লা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার ও স্লাগ, পাথর, সার প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছে নদীর পানি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিতে। কিন্তু বারবার ঘটা এই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, দূষণ ঠেকানো কিংবা ডুবে যাওয়া জাহাজ দ্রুত উত্তোলনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপই নেই। কোনো জাহাজ ডুবলে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ এনে তা উদ্ধারে সময় লাগে দু-তিন সপ্তাহ থেকে এক মাস।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, বারবার জাহাজডুবির কারণে জাহাজে থাকা পণ্য ছড়িয়ে পড়ে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণীসহ পুরো জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জলজ প্রাণী মারা যায় এবং এদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। জলজ খাদ্যশৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তিনি জানান, নদীর যে পানি দূষিত হয় তা জোয়ারের সময় বনের মাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চারা গজানো কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, জাহাজ চলাচলের কারণে সুন্দরবনের ওপর পড়া ক্ষতিকর প্রভাব নিরসনে বন বিভাগ কিংবা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্ধারকারী কোনো জাহাজ নেই।

এ ব্যাপারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, মোংলা বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকায় সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করা যায় না। জাহাজ চলাচলের কারণে পানির নিচে যে শব্দদূষণ হয়, তাতে ডলফিন, কুমিরসহ জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজের ঢেউয়ের কারণে বনের ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। গাছপালা পানিতে পড়ে যাচ্ছে। খালগুলো প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় ২০২৫ সাল থেকে ১০ বছর মেয়াদি ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এর একটি অংশে জাহাজ চলাচলের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি নিরূপণ ও নিরসনে কাজ করা হবে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, তারা ইতোমধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নামে একটি প্রকল্প নিয়েছেন। প্রকল্পের আওতায় নদীতে অয়েল স্পিল রিকভারি ভ্যাসেল ও সলিড ওয়েস্ট কালেকশন ভ্যাসেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া একটি প্লান্ট তৈরি করা হবে, সংগ্রহ করা বর্জ্য সেখানে ফেলা হবে।

মামুন রেজা, খুলনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.