একবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। এর মধ্যে রয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইউক্রেনে বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ। তবে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের হার এসব যুদ্ধকে নক্ষত্রের ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ওপর মিত্রবাহিনীর বিরামহীন হামলায়ও এত ধ্বংসলীলা সাধিত হয়নি যতটা ঘটেছে ফিলিস্তিনের এই অবরুদ্ধ উপত্যকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত একশ বছরে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার মতো দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দেখেনি বিশ্ব।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৯ হাজার ৯৫৪ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অধিকৃত পশ্চিম তীরে হত্যার শিকার হয়েছেন আরও ৪১১ জন। ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন ৭০ হাজার ৩২৫ জন। এর মধ্যে ২১ হাজারের বেশি নারী ও শিশু। গাজায় অন্তত ১২ হাজার ৬৬০ শিশু ও ৮ হাজার ৫৭০ নারী ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। বিপরীতে দুই বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ২ হাজার ৯৯২ নারী ও ৫৭৯ শিশু মারা গেছে।
ব্রিটেনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম জানুয়ারির শুরুতেই বলেছে, ইসরায়েলের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা একুশ শতকের অন্য যে কোনো বড় সংঘাতকে ছাড়িয়ে গেছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে; যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর যে কোনো বড় যুদ্ধে দৈনিক মৃত্যুর চেয়ে বেশি।
তুলনা করার জন্য দাতব্য সংস্থাটি শতাব্দীর শুরু থেকে অন্যান্য সংঘাতে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যুর তালিকা প্রদান করেছে। যেমন– সিরিয়ায় দৈনিক ৯৬.৫ জন, সুদানে ৫১.৬, ইরাকে ৫০.৮, ইউক্রেনে ৪৩.৯, আফগানিস্তানে ২৩.৮ ও ইয়েমেনে ১৫.৮ জন মারা গেছে।
গবেষণা সংস্থার সংগৃহীত স্যাটেলাইট তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলের হামলায় উত্তর গাজার সব কাঠামোর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ির পাশাপাশি স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও দোকান। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ স্কুল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞকে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিত, কর্মী, রাজনীতিবিদরা গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গত মাসে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলায় একটি অন্তর্বর্তী রুল জারি করে বলেছে, গাজায় গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ
গবেষকরা বলছেন, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সিরিয়ার আলেপ্পো, ইউক্রেনের মারিউপোল বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার চেয়েও বেশি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে ইসরায়েল। ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিন বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানে যত বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মারা গেছে গাজায়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় কী ধরনের বোমা এবং কামান ব্যবহার করছে, সে সম্পর্কে খুব কমই তথ্য দিয়েছে। তবে ঘটনাস্থলে পাওয়া বিস্ফোরণের টুকরো ও স্ট্রাইক ফুটেজ বিশ্লেষণ থেকে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত, অবরুদ্ধ ছিটমহলে ফেলা বোমাগুলোর বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত। এর মধ্যে রয়েছে দুই হাজার পাউন্ডের (৯০০ কিলোগ্রাম) ‘বাঙ্কার-বাস্টার’; যা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত শত মানুষকে হত্যা করেছে।
পেন্টাগনের সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী মার্ক গারলাসকো বলেছেন, ‘এ ধরনের বাঙ্কার-বাস্টার বোমা পৃথিবীকে তরলে পরিণত করে। এটি পুরো ভবনকে প্যানকেক বানিয়ে ফেলে। খোলা জায়গায় দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বোমার বিস্ফোরণ মানে প্রায় ৩০ মিটারের (১০০ ফুট) মধ্যে যে কারও জন্য তাৎক্ষণিক মৃত্যু।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের কোরি শের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ অঞ্চলজুড়ে ধ্বংসের মানচিত্র তৈরি করতে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাজা এখন মহাকাশ থেকে ভিন্ন রঙের দেখায়।’
মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ রবার্ট পেপ বলেছেন, ১৯৪২-৪৫ সালের মধ্যে মিত্রবাহিনী জার্মানির ৫১টি প্রধান শহর আক্রমণ করেছিল। তাতে শহুরে এলাকার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ধ্বংস হয়। এতে জার্মানির মোট ভবনের ১০ শতাংশ ধ্বংস হয়েছিল। বিপরীতে মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল গাজার ৩৩ শতাংশ ভবন শেষ করে দিয়েছে ইসরায়েল।
ইরাকি শহর মসুল থেকে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের ২০১৭ সালে ৯ মাসের যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সংঘাতগুলোর পর্যালোচনা করে থাকে লন্ডনভিত্তিক স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এয়ারওয়ারস। তাদের হিসাবে, ইরাকে ২০১৪-১৭ সালের যুদ্ধে মার্কিন জোট সারাদেশে প্রায় ১৫ হাজার হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গাজায় ৪৫ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ও বড় বোমা হামলা চালিয়েছে। তিন মাসেই নিক্ষেপ করেছে ৬৫ হাজার টন বোমা।
ইউরো-মেড মনিটর বলেছে, গাজায় প্রায় ৬৯ হাজার ৭০০টি আবাসন ইউনিট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ আবাসিক ইউনিট আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
টেক্সাসের স্যাম হিউস্টন স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক জেইনাব শুকর এক নিবন্ধে বলেছেন, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজার জমি ও পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতি পশ্চিমা সরকারগুলোর সমর্থন বন্ধ করতে ওপর থেকে চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী ২ মার্চ গণসংহতি সমাবেশ করার আহ্বান জানিয়েছে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস। জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক প্রধান রমেশ রাজাসিংহাম ২৭ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, গাজার ৫ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ বা জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ আসন্ন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন।
একঘরে ইসরায়েল
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সদ্যসমাপ্ত শুনানিতে ইসরায়েলের একাকিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। একজন নীতি বিশেষজ্ঞ এ ঘটনাকে বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বিচ্ছিন্নতার একটি ‘অত্যাশ্চর্য’ প্রদর্শন বলে মন্তব্য করেছেন।
সোমবার শেষ হওয়া ছয় দিনের শুনানিতে গত ৫৭ বছরে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের পক্ষে মাত্র চারটি দেশ তেল আবিবের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি তিনটি দেশ হলো যুক্তরাজ্য, হাঙ্গেরি ও ফিজি। বিপরীতে ৪৫টি দেশ ও তিনটি সংস্থা ইসরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে স্বঘোষিত ‘ইহুদিবাদী’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, বর্তমানে ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। সূত্র : আলজাজিরা, এপি, নিউইয়র্ক টাইমস, আনাদলু এজেন্সি ও মিডল ইস্ট মনিটর।