লোডশেডিংয়ের মধ্যে ঢাকায় পানিরও সংকট

0
216
ঢাকা ওয়াসা

রাজধানীর আফতাবনগরের জি ব্লকে দুই দিন ধরে ঢাকা ওয়াসার লাইনে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাসিন্দারা দুই দিন ধরে পাশের বনশ্রী থেকে পানি আনতেন। গতকাল মঙ্গলবার বনশ্রীতেও পানির সংকট দেখা দেয়।

আফতাবনগরের জি ব্লকের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানিও যদি না থাকে, তাহলে মানুষ বাঁচে কী করে। এখন তো আরও বেশি পানি লাগে। কিন্তু পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

পানিসংকটের এই চিত্র শুধু আফতাবনগরে নয়, রাজধানীর অন্তত ৩৫টি এলাকা থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ওয়াসার লাইনে চাহিদামতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ওয়াসা গাড়ির মাধ্যমে যে পানি বিক্রি করে, তা–ও চাহিদামতো কিনতে পারছেন না কিছু এলাকার মানুষ।

ঢাকা ওয়াসা বলছে, লোডশেডিংয়ের কারণে তারা ঠিকমতো পানির পাম্প চালাতে পারছে না। বিপরীতে প্রচণ্ড গরমের কারণে পানির চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়েছে—দুইয়ে মিলে সংকট তৈরি হয়েছে।

পানির সরবরাহ অতি জরুরি একটি সেবা। লোডশেডিং বা অন্য কোনো কারণে এই সেবায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেটির প্রস্তুতি থাকা উচিত।
অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে সব পাম্প চালানো যাচ্ছে না। কারণ, সব পাম্প চালানোর মতো জেনারেটর নেই। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুতের সমস্যা কমলে কিংবা দু-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে পানির সমস্যা কমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

চাহিদা কত, উৎপাদন কত

ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন ২৫৫ থেকে ২৬০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ওয়াসা প্রায় ২৮০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। কিন্তু সরবরাহকালে অপচয় (সিস্টেম লস, যা প্রায় ২০ শতাংশ) এবং পাম্প নষ্ট হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই এলাকাভিত্তিক কিছু সমস্যা তৈরি হয়।

ওয়াসা বলছে, গরমের কারণে এখন পানির চাহিদা বেড়ে দৈনিক ৩০০ কোটি লিটারের কাছাকাছি চলে গেছে। ফলে বেশিসংখ্যক এলাকায় সংকট দেখা দিয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির প্রায় ৬৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে গভীর নলকূপ দিয়ে টেনে এই পানি তোলা হয়। সংস্থাটির তথ্য বলছে, এখন ঢাকা ওয়াসার ১ হাজার ৬১টি পাম্প (স্ট্যান্ডবাইসহ) রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলে ওয়াসা নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে পাম্পগুলো চালায়। তবে জেনারেটর দিয়ে সব পাম্প চালানোর মতো সক্ষমতা ওয়াসার নেই। অনেক পাম্প বন্ধ রাখতে হয়।

রাজধানীতে গরমের সঙ্গে পানির কষ্ট

সংস্থাটির একটি সূত্র বলছে, ঢাকা ওয়াসায় এখন সব মিলিয়ে ৪০০টির মতো জেনারেটর আছে।

ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহের ব্যবস্থাটি ১০টি জোন বা অঞ্চলে বিভক্ত। অঞ্চলগুলো থেকে গত সোমবারের সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা গেছে, পাঁচটি অঞ্চলে (১, ২, ৩, ৫ ও ১০) বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের কারণে বেশি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এসব অঞ্চলের পাম্পগুলো গত সোমবার মোট ১৫৮ বার বিদ্যুতের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগের দিন এসব অঞ্চলের পাম্প ১৪৯ বার বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের শিকার হয়।

যেসব এলাকায় পানিসংকট

পুরো ঢাকা শহরেই পানি সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ঢাকা ওয়াসা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, অন্তত ৩৫টি এলাকায় গতকাল পানির সংকট ছিল।

ঢাকার জোয়ারসাহারার হিমবাড়ি এলাকার এক বাসিন্দা জানান, তাঁরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার পানি পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে সংস্থাটিতে অভিযোগ করেও তাঁরা কোনো প্রতিকার পাননি। এতে ওই এলাকার মানুষ খুব দুর্ভোগে পড়েছেন।

একই ধরনের অভিযোগ করেছেন আফতাবনগর ও বনশ্রী এলাকার একাধিক বাসিন্দা। আফতাবনগর ও জোয়ারসাহারা এলাকাটি ঢাকা ওয়াসার অঞ্চল–৮–এর আওতায় পড়েছে। একই অঞ্চলের আওতাধীন ছোলমাইদ, বাড্ডা, শাহজাদপুর এলাকায়ও পানিসংকট রয়েছে।

দেশে পানির দামে এত বৈষম্য কেন

অঞ্চল–১–এর আওতাধীন কাজলারপাড়, দয়াগঞ্জ, কেবি রোড, মধ্য বাসাবো মাঠ–সংলগ্ন এলাকা, মানিকনগর; অঞ্চল–৩–এর আওতায় থাকা মোহাম্মদপুরের চাঁন মিয়া হাউজিং, আদাবর, শ্যামলী, পূর্ব রাজাবাজার ও ক্রিসেন্ট রোড; অঞ্চল–৫–এর আওতাধীন মহাখালী-জ ব্লক; অঞ্চল–৬–এর আওতাধীন নন্দীপাড়া; অঞ্চল–৭–এর আওতাধীন জুরাইন, মাতুয়াইল, রহমতপুর, কোনাপাড়া, ডগাইর ও কদমতলী এলাকায় পানিসংকটের তথ্য পাওয়া গেছে।

অঞ্চল–৯–এর উত্তরা সেক্টর ১১ ও ১২ এবং উত্তরখান ও দক্ষিণখানে পানির সংকট আছে। অঞ্চল–১০–এর মধ্যে ইব্রাহিমপুর, কাফরুল, ভাষানটেক, মিরপুর–১১–এর বি ব্লকে পানি নিয়ে অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা।

বাসিন্দারা জানান, কোনো কোনো এলাকায় পানির সরবরাহ কম। কোনো কোনো এলাকায় দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টায় এক–দুবার পাওয়া যায়।

অভিযোগ চার শতাধিক

ঢাকা ওয়াসার লাইনে পানি না থাকলে অথবা পানিসংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে সংস্থাটির হটলাইন নম্বর ওয়াসা লিংক-১৬১৬২-এ অভিযোগ করা যায়। ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার ওয়াসা লিংকে ফোন করে ৪৫৬ জন পানি নিয়ে নানা অভিযোগের কথা জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই ছিল পানি না পাওয়া নিয়ে। তবে কেউ কেউ পানিতে গন্ধ নিয়েও অভিযোগ করেছেন। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে অঞ্চল–৩ (লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকা) থেকে। রোববারও পানি নিয়ে ওয়াসা লিংকে ৪১৮টি অভিযোগ এসেছিল।

মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ার টেকের এক বাসিন্দা জানান, তিন দিন ধরে তাঁর বাসায় ওয়াসার সরবরাহ করা লাইনের পানিতে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসা ১৩ বছরে অন্তত ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। সংস্থাটি বিপুল অর্থব্যয়ে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, জেনারেটরের অভাবে লোডশেডিংয়ের সময় তারা পাম্প চালাতে পারছে না।

গাড়ির পানিও মিলছে না

ঢাকা ওয়াসার লাইনে পানি না পাওয়া গেলে একমাত্র বিকল্প সংস্থাটির কাছ থেকে পানি কেনা, যা গাড়ির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। দুই, সাড়ে তিন, পাঁচ ও ছয় হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার গাড়ি রয়েছে। দাম ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সংস্থাটির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে ১ হাজার ৫৪৮ গাড়ি পানির চাহিদা এসেছে। কিন্তু এর বিপরীতে ৭৩২ গাড়ি পানি সরবরাহ করতে পেরেছে সংস্থাটি।

ঢাকা ওয়াসা ১৩ বছরে অন্তত ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। সংস্থাটি বিপুল অর্থব্যয়ে বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, জেনারেটরের অভাবে লোডশেডিংয়ের সময় তারা পাম্প চালাতে পারছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পানি সরবরাহ অতি জরুরি একটি সেবা। লোডশেডিং বা অন্য কোনো কারণে এই সেবায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেটার প্রস্তুতি থাকা উচিত। তিনি বলেন, বিদ্যুতের চেয়ে পানিসংকটে মানুষের ভোগান্তি বেশি হয়। অসন্তোষও বেশি হয় পানিসংকটে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.