বেতনেই চলে যায় মাসে ২ লাখ ডলার

0
138
কোচিং স্টাফ নিয়োগ বিশ্বের

বিদেশি কোচিং স্টাফ নিয়োগ বিশ্বের সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেই দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এই তালিকায় বোধহয় ক্রিকেট বিশ্বের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিসিবিতে এ মুহূর্তে ২১ জন বিদেশি কোচিং স্টাফ চাকরি করছেন।

এছাড়া খণ্ডকালীন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক কোচ এবং মনোবিদ নিয়োগে সংখ্যাটা আরও বেশি। যাঁদের পেছনে প্রতি মাসে বেতন বাবদ প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার ইউএস ডলার (টাকার অঙ্কে যা প্রায় আড়াই কোটি) খরচ করছে বিসিবি। ডলারে বেতন দেওয়ায় মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি মাসেই ব্যয় করতে হচ্ছে।

অথচ এক বছর আগেও এত বেশি সংখ্যক বিদেশি কোচ বা সাপোর্ট স্টাফ ছিল না বিসিবিতে। ২০২১-২২ ক্রিকেট পঞ্জিকাবর্ষের চেয়ে অন্তত ৮ জন বিদেশি বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চলতি মৌসুমে। সেদিক থেকে বলতে গেলে অতিমাত্রায় বিদেশিনির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের ক্রিকেট। এই মুহূর্তে কৃচ্ছ্রসাধন এবং সরকারের আর্থিক নীতির কারণে দুষ্প্রাপ্য ইউএস ডলার। এর ভেতরেও বিদেশিদের পেছনে বিসিবিকে প্রতি মাসে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের ডলার।

বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন বিষয়টিকে প্রয়োজন হিসেবে দেখছেন। দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে বিদেশি কোচ বাড়াতে হয়েছে বলে দাবি তাঁর। সুজন বলেন, ‘এই কোচ নিয়োগের পরিকল্পনা আগেই নেওয়া হয়েছিল। এখন সেটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যে কারণে কোচ বেশি মনে হচ্ছে। আসলে দেশে পর্যাপ্ত কোচ না থাকায় বিদেশ থেকে আনতে হয়। এই বিদেশি কোচিং স্টাফের বেতন দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈধ চ্যানেলে। আগে থেকেই অনুমোদন নেওয়া আছে। আশা করি, এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য এই টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।’

সর্বোচ্চ বেতন হাথুরুসিংহের: গত এক যুগ ধরে বিদেশি কোচিং ও সাপোর্ট স্টাফ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে জাতীয় দল। বর্তমানে জাতীয় দলে বিদেশি কোচিং স্টাফ রয়েছে সাতজন। জানা গেছে, প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে রেকর্ড ৩২ হাজার ৫০০ ডলার বেতন নেন। ৩০ শতাংশ কর বাদ দিলে ২৫ হাজার ডলার দেশে নিয়ে যেতে পারেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এ শ্রীলঙ্কানের পেছনে বছরে আরও অনেক খরচ রয়েছে। তাঁর জন্য বছরে বিমান ভাড়া বাবদ বরাদ্দ ২৫ লাখ টাকা।

এছাড়া জাতীয় দল ম্যাচ জিতলে ‘উইনিং’ বোনাস দিতে হয় তাঁকে। তিনি ঢাকায় আবাসন ও পরিবহন সুবিধা ভোগ করেন বিসিবির টাকায়। জাতীয় দলের বাকি কোচিং এবং সাপোর্ট স্টাফরাও বেতনের বাইরে চন্ডিকার মতো বাকি সুবিধা ভোগ করে থাকেন। যেগুলোর ব্যয় নির্বাহ করতে হয় বিসিবিকেই। জাতীয় দলের কোচিং স্টাফের বেতনের পেছনেই মাসে ৯৭ হাজার ইউএস ডলার বা ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা খরচ ক্রিকেট বোর্ডের। পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে যা অন্তত ১০ লাখ টাকা বেশি।

বিসিবিতে দায়িত্বরত বিদেশিদের বেতন।

বাংলাদেশ টাইগার্সেও বিদেশি কোচ: বাংলাদেশ ‘এ’ আর ‘বাংলাদেশ টাইগার্স’ দলে এ বছর থেকে বিদেশি কোচ রাখায় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হচ্ছে । বিসিবির ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া জেমি সিডন্সের বেতন মাসে ১৬ হাজার ডলার। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা পেস বোলিং কোচ চম্পকা রামানায়েককে দিনে দিতে হয় সাড়ে ৬০০ ডলার। মাসের হিসাবে প্রায় ২০ হাজার ডলার বেতন এ শ্রীলঙ্কানের। বিগত কয়েক বছর এইচপিতে কাজ করা চম্পকাকে এ বছর ‘এ’ দল ও টাইগার্সের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে বিসিবি। তার সঙ্গে বোর্ডের চুক্তি শেষ হবে এ বছর ৩০ জুলাই।

জেমি ও চম্পকার বেতন প্রায় ৩৬ হাজার ডলারের কাছাকাছি। মে মাসে এ দুই কোচের পেছনে বেতন বাবদ প্রায় ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে বিসিবিকে। এই কোচদেরও বিমান ভাড়া আর ঢাকার আবাসন সুবিধা দিতে হয়। অথচ এক বছর আগেও ‘এ’ দল আর বাংলাদেশ টাইগার্সে বিদেশি কোচ ছিল না। দেশি কোচরা কাজ করায় মোটা অঙ্কের টাকা বেচে গেছে বিসিবির।

এইচপিতে বিদেশি কোচ বাড়ছে: ইংলিশ টবি রেডফোর্ডকে চুক্তিভিত্তিক প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও মাত্র এক মাস কাজ করেছেন। আসি আসি করে এরপর আসা হয়নি তাঁর। তাই ২০২২ সালে এইচপির ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন চম্পকা।

এবার ডেভিড হেম্পকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্ভবত মাসে ৭ হাজার ডলার বেতনে। পেস বোলিং কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কলি মোরকে বেতন দেওয়া হতে পারে ৯ হাজার ডলার। এ মাসেই কাজে যোগ দেবেন এ ক্যারিবিয়ান। একজন মনোবিদও কাজ করবেন এইচপির সঙ্গে। বিসিবির হেড অব প্রোগ্রাম ডেভিড মুরের সুপারিশে বিদেশি কোচ নিয়োগ করা হয়েছে। এইচপির বিদেশি কোচিং স্টাফের বেতনের পেছনে আগামী মাস থেকে বিসিবির খরচ হবে প্রায় ১৬ হাজার ডলার বা ১৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই বিভাগেও গত বছরের চেয়ে বিদেশি কোচ একজন বেড়েছে।

অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খণ্ডকালীন পরামর্শক: বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিদেশি কোচ দিয়েই পরিচালিত হয়। ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বিদেশি কোচদের। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রধান কোচ স্টুয়ার্ট ল সাড়ে ১০ হাজার আর ব্যাটিং কোচ ভারতের ওয়াসিম জাফর মাসে ১০ হাজার ডলার বেতন পান। ২০২০ বিশ্বকাপ প্রধান কোচ শ্রীলঙ্কান রানা নাভিদের সঙ্গে ট্রেনার ছিলেন স্টুয়ার্ট স্টয়নিস। বাকিরা ছিলেন স্থানীয় কোচ। এবার বাড়তি যোগ করা হয়েছে ব্যাটিং কোচ ওয়াসিমকে। ট্রেনার অ্যালেক্স ক্যারিকে নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে বিদেশি কাজ করেন তিনজন। এই কোচদের পেছনে মাসে সাড়ে ২৫ হাজার ডলার বা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে।

প্রথমবার নারী দলে বিদেশি প্যানেল: ২০২১-২২ ক্রিকেট বর্ষে নারী জাতীয় দলে বিদেশি কোচিং স্টাফ ছিল একজন। এ মাস থেকে জাতীয় নারী দলে তিনজন বিদেশি কাজ করছেন। প্রধান কোচ শ্রীলঙ্কান হাসান তিলকারত্নে গত বছর অক্টোবরে নিয়োগ পান। গত মাসে শ্রীলঙ্কান নারী ফিজিও তাকসিম ইউসুফকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ মাসে যোগ করা হয়েছে একজন ট্রেনার ইয়ান ডুরান্টকে। নারী দলের বিদেশি কোচিং স্টাফের বেতন বাবদ মাসে ১৫ লাখ টাকার মতো খরচ।

বিসিবি হেড অব প্রোগ্রাম ডেভিড মুরের বেতন ১০ হাজার ডলার বা সাড়ে ১০ লাখ টাকা। রস টার্নারের পর লম্বা বিরতি দিয়ে হেড অব প্রোগ্রাম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রিহ্যাব সেন্টারও বিসিবির নতুন সংযোজন। জাতীয় দলের সাবেক ফিজিও জুলিয়ান ক্যালেফাতো কাজ করছেন রিহ্যাব সেন্টারে মাসে ৮ হাজার ডলার বেতনে।এই স্থায়ী কোচ ছাড়াও খণ্ডকালীন হিসেবে জাতীয় দলের জন্য মাইন্ড ট্রেনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যালান ব্রাউনকে। আগস্টে জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত হবেন অস্ট্রেলিয়ান মনোবিদ ড. ফিল জোন্স। ফলে নিয়মিত কোচিং ও সাপোর্ট স্টাফের বাইরেও বিদেশিদের পেছনে খরচ করতে হয় বোর্ডকে।

কিউরেটর নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন: বিশ্বের অন্য কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশে স্থায়ীভাবে কিউরেটর নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা নেই। সেখানে বিসিবিতে দু’জন বিদেশি কিউরেটর কাজ করছেন– শ্রীলঙ্কান গামিনি ডি সিলভা ও ভারতের প্রবীন হিঙ্গিকার। গামিনি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছেন এক দশক হলো। মাসে সাড়ে ৩ হাজার ডলার বেতন পান এ লঙ্কান। অথচ বিসিবি ইচ্ছা করলে বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো মানের কিউরেটর তৈরি করতে পারত।

এই বিভাগে সাবেক ক্রিকেটার না পাওয়ার পেছনে কারণও রয়েছে। দেশিদের কদর নেই বোর্ডে। শ্রীলঙ্কান বা ভারতীয়দের হাজার হাজার ডলার দিতে পারলেও দেশিদের বেতন সামান্যই। বিসিবির এই নীতিমালাই বাংলাদেশে কিউরেটর বা ভালো কোচ তৈরিতে প্রধান অন্তরায়। অথচ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় বিদেশিদের মতো দেশি কোচ, কিউরেটর এবং আম্পায়ারদের প্রায় সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। ফলে দেশগুলোতে বিদেশ থেকে কিউরেটর বা আম্পায়ার নিয়োগ দিতে হয় না।

ডলার নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই বিসিবির: বোর্ডের বিদেশিনির্ভর হয়ে পড়ার কারণও রয়েছে। আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় টাকা বা ডলার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। নিজেদের কোষাগার থেকেই সব খরচ বহন করতে পারে। আইসিসির রেভিনিউয়ের ভাগ, টিভি সম্প্রচার স্বত্ব, টিকিট বিক্রি ও ইনস্টিডিয়া স্বত্ব, কিট স্পন্সর থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আয় করে ক্রিকেট বোর্ড। যেখান থেকে দেশের ক্রিকেটের ব্যয় নির্বাহের পরও ব্যাংকে সঞ্চয় বাড়াতে পারে। গত আট বছরে আইসিসি থেকে ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার দেশে এনেছে বিসিবি। প্রতি বছর আইসিসি থেকে বিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। মাসের হিসাবে ১৩ লাখ ডলারের বেশি। অর্থাৎ গত আট বছর ধরে আইসিসি থেকে মাসে ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয় করেছে বিসিবি। এই আর্থিক সচ্ছলতার কারণেই হয়তো বিদেশিনির্ভরতা বেড়েছে দেশের ক্রিকেটে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.