লেখক হওয়ার তেমন কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না—সমরেশ মজুমদার

0
139
সমরেশ মজুমদার।

আজ সোমবার সন্ধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের এই লেখক। তখন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এখানে প্রকাশিত হলো সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আবুল বাসার

আবুল বাসার: প্রথমেই জানতে চাই, আপনার লেখালেখি শুরু হলো কীভাবে? এত কাজ থাকতে লেখালেখিকেই কেন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন?

সমরেশ মজুমদার: লেখক হওয়ার তেমন কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে থাকতে নাটক করার প্রবণতা ছিল আমার। আমাদের ওখানে তখন গ্রুপ থিয়েটারের চল ছিল বেশি। কিন্তু থিয়েটারে নাটক করতে হলে নতুন নাটক করতে হয়। তবে সে সময় বিশেষ পরিচিত নাট্যকারেরা নতুন কোনো থিয়েটারের জন্য নাটক লিখে দিতেন না। তাঁরা আসলে নতুন থিয়েটার দলকে নাটক দিয়ে ভরসা পেতেন না।

ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার ঝোঁক ছিল। সে কারণেই বন্ধুরা আমাকে বলল, তাদের থিয়েটারের জন্য নাটক লিখতে। এ যেন বাজারে গিয়ে সবজি কিনে আনার মতো সহজ কাজ। আমি আগামাথা কিছু না ভেবেই মাথা চুলকে বলে দিলাম, ‘হ্যাঁ, লিখব।’

পরদিন অনেক ভেবেচিন্তে একটা নাটকের প্রথম দৃশ্য লিখলাম। নিয়ে গেলাম দলের কাছে। সবার সামনে পড়া হলো নাটকটা। নিজের নাটক ওভাবে সবার সামনে পড়তে শুনে বুঝলাম, কিছুই হয়নি। লজ্জায় আমার মুখটা ছোট হয়ে এল। আমার বন্ধু বলল যে ওটা নাকি নাটকের ‘ন’–ও হয়নি।

তো সে আমাকে আবারও ভরসা দিল। বলল, ‘তুই তো গল্প পড়িস। আগে একটা গল্প লেখ। তারপর সেটাকে নাট্যরূপ দে।’

যে–ই কথা সে–ই কাজ। আমি তিন দিন ধরে ভেবেচিন্তে একটা গল্প লিখলাম। তারপর সেটাকে নাটক বানাতে বসলাম। এসব করছি আমি ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে। নাটকে নায়ক গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। যেতে যেতে পথিমধ্যে একজনের সঙ্গে ঝামেলা হলো। ওই মানুষটা নায়ককে ধাক্কা দিয়ে ট্রাম থেকে ফেলে দিল। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। আমার বন্ধুরা আমাকে চেপে ধরল, ‘আরে, তুই পাগল নাকি? মঞ্চের ভেতর ট্রাম চলবে কী করে? আবার সেই ট্রাম থেকে নায়ককে ফেলে দেওয়া সহজ ব্যাপার নাকি? যাহ! তোর দ্বারা এসব নাটক লেখা হবে না।’

এরপর আমি গল্প লিখে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকাতে প্রথম আমার লেখা ছাপা হলো।

আবুল বাসার: ১৯৬৭ সালে প্রথম গল্প। এরপর ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৭৬ সালে ‘দৌড়’ উপন্যাস দিয়ে আপনার লেখালেখির শুরু। পরে প্রায় ৫০ বছর ধরে একের পর এক উপন্যাস বা গল্প দিয়ে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। কখনো কি ক্লান্তি ভর করেছে?

সমরেশ মজুমদার: না, সেভাবে ক্লান্তি বোধ করিনি কখনো। ভালো-মন্দ মিশিয়ে বেশ লিখছিলাম তো। বছর দুয়েক আগে আমার একটা ছোট স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের পর হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কীভাবে আমি যেন অনেক কিছু ভুলে যাই।

আমার অনেক আত্মীয়স্বজনের নামও ভুলে যাচ্ছিলাম। বাংলা অক্ষর, ইংরেজি অক্ষর মিলিয়ে ফেলছিলাম আমি। ডাক্তারবাবুরা অনেক থেরাপির কথা বলছিলেন তখন। সবাই ধরে নিয়েছিল, আমার বোধ হয় জীবন শেষে হয়ে এল।

আমার মেয়ে তখন আমাকে একটা ‘বর্ণপরিচয়’ বই আর চক-স্লেট কিনে দেয়। আমরা সে সময় একসঙ্গে বসে ‘বর্ণপরিচয়’ দেখে স্লেটে আঁকিবুঁকি করতাম। একটা শিশুর মতো ও আমাকে শেখাত। এরপর শব্দ, বাক্য মিলিয়ে লিখতে শুরু করলাম একটু একটু। এরই মধ্যে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন, কেমন আছি। তাঁকে জানালাম যে শরীরটা চলছে ভালোই। এই সুযোগে তিনি আমার কাছে পূজা সংখ্যার জন্য উপন্যাস চাইলেন। আমি শুধুই হাসলাম তাঁর কথায়।

পরে উপন্যাস দেওয়ার শেষ সময় পেরোনোর দুই মাস পর তিনি আমাকে আবার ফোন দিলেন। তাঁর ফোন পেয়ে আমি আরও এক মাস পর উপন্যাসের প্লট নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি।

কিন্তু আমি ভাববই–বা কী? আমি তো কিছু মনেই করতে পারছি না। তারপর ধীরে ধীরে লিখলাম গোটা উপন্যাসটা। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, উপন্যাসটা আমি পড়তে পারলাম না। তাই সম্পাদককে ফোন করে বললাম, ‘আপনারা তো আমার লেখা না পড়েই ছাপেন। কিন্তু এবারটি সে রকম করবেন না। ঠিকমতো পড়ে দেখবেন সবাই। লাগলে সংশোধন করবেন।’

তিনি আমাকে সাত দিন পর ফোন করে বললেন, ‘আপনি এমন অভিনয় করেন কেন? কোনো অসুবিধায়ই তো নেই উপন্যাসে।’

আগে লিখতে হলে আমাকে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যেতে হতো না। মাথার ভেতর গল্প চলতে থাকত। কিন্তু এখন গল্প খুঁজে বেড়াতে হয়। চিন্তা করতে হয় দীর্ঘ সময়। উদ্ভট উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় ভিড় করে।

এমন উদ্ভট কল্পনা নিয়ে লিখতে বসলে তখন মনে হয় এসব তো সবাই–ই জানে। নতুন করে লেখার কিছু নেই। তাহলে আর লিখে কী লাভ?

১৯৪৭ ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হওয়া থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম—এই বিশাল সময়ে যে মানুষগুলো উপমহাদেশের ভাঙা-গড়ার সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তখনকার মুসলিম লীগের সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষদের মানসিকতা সেভাবে মিলত না। এ দেশের লোকেরা ছিল শ্যামলা বর্ণের। সেখানে মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতা ছিলেন উজ্জ্বল বর্ণের মানুষ। তাঁরা অধিকাংশ এসেছিলেন উপকূল অঞ্চল থেকে।

মুসলিম লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু জনগণ তাঁদের পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কথাতেই যেন বুকে সাহস ফিরে পেল গোটা বাঙালি জাতি। এসব ইতিহাস আমি উপন্যাস আকারে তিন খণ্ডে লিখব ভেবেছিলাম। প্রথম খণ্ড হবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয় খণ্ডে ’৫২ থেকে ’৫৮ সালের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আর শেষ খণ্ড হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এটা লেখার খুব স্বপ্ন আছে আমার। তবে লিখতে বেশ ভয় লাগে। আমি যে বয়সে এসে পৌঁছেছি, সেখানে এসে এত বড় উপন্যাস লিখে শেষ করতে পারব কি না, সেই ভয় থেকেই যায়।

বছর দুয়েক আগে আমার একটা ছোট স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের পর হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কীভাবে আমি যেন অনেক কিছু ভুলে যাই। আমার অনেক আত্মীয়স্বজনের নামও ভুলে যাচ্ছিলাম। বাংলা অক্ষর, ইংরেজি অক্ষর মিলিয়ে ফেলছিলাম আমি। ডাক্তারবাবুরা অনেক থেরাপির কথা বলছিলেন তখন। সবাই ধরে নিয়েছিল, আমার বোধ হয় জীবন শেষে হয়ে এল।

সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার
সমরেশ মজুমদার

আবুল বাসার: দেশে–বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা? কোন লেখকের দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন?

সমরেশ মজুমদার: সমরেশ বসু ও বিমল করের লেখা পড়ে প্রভাবিত হয়েছি। তাঁদের লেখা পড়ে মনে হয়েছে, তাঁরা মানুষের ভেতরের কথা বলেন। জানি না, কীভাবে আমি তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হলাম! লিখতে লিখতে খেয়াল করেছি যে আমি বিমলদার মতো মানুষের ভেতরের কথা বলি।

আবার সমরেশ বসুর মতো মানুষের চারপাশের উপজীব্য বিষয় নিয়েও আমি লিখতে পছন্দ করি। আমি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ—এঁদের কথা বাদ দিচ্ছি! তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তাঁদের বইও তো আমাকে লেখার বিভিন্ন ধাপে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

আর বিদেশি বইগুলোর ভেতরে অনেক বই–ই আসলে পড়া হয়েছে। তাই আলাদা করে কারও নাম বলতে পারব না।

আবুল বাসার: আপনার লেখার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তারপরও কখনো কি মনে হয়েছে অমুক লেখকের মতো যদি লিখতে পারতাম?

সমরেশ মজুমদার: আমার কবিতার প্রতি ঝোঁক আছে। জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমি খুব পড়ি। তবে তাঁদের মতো কবিতা আমি লিখতে পারি না। তাঁদের কবিতায় যে মানুষের ভেতরের গল্প তৈরি হয়, তাঁদের কবিতা যেভাবে মানুষকে হতবিহ্বল করে তোলে, সেভাবে কবিতা আমি লিখতে পারিনি। তাঁদের এসব কবিতা পড়ে অনেক বছর বেঁচে থাকার রসদ পাওয়া যায়।

আমার কবিতার প্রতি ঝোঁক আছে। জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমি খুব পড়ি। তবে তাঁদের মতো কবিতা আমি লিখতে পারি না। তাঁদের কবিতায় যে মানুষের ভেতরের গল্প তৈরি হয়, তাঁদের কবিতা যেভাবে মানুষকে হতবিহ্বল করে তোলে, সেভাবে কবিতা আমি লিখতে পারিনি। তাঁদের এসব কবিতা পড়ে অনেক বছর বেঁচে থাকার রসদ পাওয়া যায়।

সমরেশ মজুমদার

আবুল বাসার: কখনো কি কবিতা লিখেছেন?

সমরেশ মজুমদার: আমি কোনো দিন কবিতা লিখিনি—বিষয়টা আংশিক সত্য। একবার–দুবার চাপে পড়ে লিখেছি কয়েক লাইন। কিন্তু সেই কবিতা ঠিক আমার কাছে কবিতা হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া গান লেখার শখ আমার হয়েছিল। কিছু গান রেকর্ডও করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখার ইচ্ছা ছিল সমরেশ মজুমদারের
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখার ইচ্ছা ছিল সমরেশ মজুমদারেরছবি: প্রথম আলো

আবুল বাসার: অন্তর্জাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে কি মানুষের বই পড়ার সময় কমে যাচ্ছে? ভবিষ্যতে বই কি হারিয়ে যাবে?

সমরেশ মজুমদার: আমার কিন্তু তা মনে হয় না। এখনকার অধিকাংশ পাঠক ২০–৩০ বছর বয়সী। তাঁদের নানা রকম বই নিয়ে ধারণা আছে। ফলে বই বিক্রি কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।

আবার এটাও সত্য যে বই ছাড়াও মানুষ নানাভাবে কাহিনি শুনতে চায়। কিছুদিন পরেই কলকাতার একটা চ্যানেলে আমার ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটি টেলিভিশন সিরিজ আকারে দ্বিতীয়বারের মতো প্রচারিত হবে। ২১ বছর আগে একবার এটি টিভি ধারাবাহিক হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। সাহিত্যের কদর আছে বলেই বোধ হয় ওরা দ্বিতীয়বার এটা করছে। মানুষ বই না ভালোবাসতে পারে, কিন্তু আলাদাভাবে সাহিত্যের একটা মূল্যায়ন থাকবে সব সময়।

সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন: আলিমুজ্জামান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.