রাষ্ট্রহীন এক রাষ্ট্রদূত তিনি

0
109
জালমাই রসুল, ফাইল ছবি: এএফপি

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তালেবান। সরকার গঠন করে তারা। সেই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি জাতিসংঘসহ এর সদস্যদেশগুলো। ফলে বিদেশে অনেক দূতাবাসে এখন তালেবান সরকারের প্রতিনিধি নেই। যেমন লন্ডনে আফগান দূতাবাস। সেখানে এখনো রাষ্ট্রদূত হিসেবে রয়ে গেছেন আগের আশরাফ গনি সরকারের নিয়োগ দেওয়া দূত জালমাই রসুল। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে দুবার পুলিৎজারজয়ী লেখক স্টিভ কোলের। ওই আলাপচারিতার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্কারে। লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠকদের জন্য বাংলা করা হলো।

বাদশাহ আমানুল্লাহ খান। ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানের স্বাধীনতার পর রাজক্ষমতায় বসেন তিনি। দেশে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে কম চেষ্টা করেননি। সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। পরে ১৯২৫ সালে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে একটি চারতলা বাড়ি কিনে দূতাবাস খোলেন। তবে আমানুল্লাহর এসব সংস্কারের প্রচেষ্টা বেশি দূর এগোয়নি। সহিংস এক বিদ্রোহের মুখে ১৯২৯ সালে তাঁকে কাবুল ছেড়ে পালাতে হয়। ১৯৬০ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে মারা যান। তবে এখনো রয়ে গেছে লন্ডনে চারতলা সেই দূতাবাস।

আমানুল্লাহ খানের ভাতিজা জালমাই রসুলের বয়স এখন ৮০ বছর। তিনি বসবাস করছেন লন্ডনে সেই দূতাবাসের ওপরের তলায়। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তাঁকে যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট গনি সরকারের পতন হয়। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করা বিদেশি সেনাদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। আশরাফ গনি একটি হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান। আর জালমাই রসুলকে থেকে যেতে হয় লন্ডনের সেই দূতাবাসে।

আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের স্বীকৃতি দেয়নি জাতিসংঘ ও এর সদস্যদেশগুলো। তবে ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, জালমাই রসুল আফগানিস্তানের দূত হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। সে অনুযায়ী লন্ডনের ওই বাসার ওপরে দুই বছর ধরে আফগানিস্তানের পতাকা উড়ছে। সম্প্রতি জালমাই রসুল চা খেতে খেতে আমাকে বলছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যুক্তরাজ্যের অতিথি। এটা খুবই অবাক করার মতো। যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমি বলি আফগান মানুষের। কারণ, আমাদের সরকার এখন নেই।’

আফগানিস্তানে তালেবানের বর্তমান সরকারের আগের সময়ের রাষ্ট্রদূত হিসেবে শুধু জালমাই রসুলই আফগান দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করছেন না। যখন কাবুলের পতন হয়েছিল, তখন সারা বিশ্বে আফগানিস্তানের প্রায় ৪০টি দূতাবাস ছিল। এখন প্রায় ২০টি দূতাবাস রয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগই ইউরোপে। এ ছাড়া অটোয়া, সিউলসহ কয়েকটি রাজধানীতে আফগানিস্তানের দূতাবাস রয়েছে। সেগুলো তালেবান–পূর্ব সরকারের সময় দূতদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তবে বেইজিং, ইসলামাবাদসহ কয়েকটি রাজধানীতে আফগান দূতাবাসে তালেবানের নিয়োগ দেওয়া দূত রয়েছেন। এ বিষয়ে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি বলেন, আফগানিস্তানের ১৪টি দূতাবাসে তালেবানের নিয়োগ দেওয়া দূত রয়েছেন। আর যেসব দূতাবাসে আগের সরকারের নিয়োগ দেওয়া কূটনীতিক রয়েছেন, তাঁরাও কাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।

লন্ডনে আফগান দূতাবাসটি একটি চার তারকা হোটেলের মতো। সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে জালমাই রসুল সকাল নয়টায় নিচতলায় যান। সেখানে তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

বিভিন্ন দেশে তালেবান–পূর্ব সরকারের যেসব রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে জালমাই রসুল সবচেয়ে পরিচিত মুখ। তিনি পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সে। এরপর গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে তালেবানের প্রথম মেয়াদের শাসনের সময় তিনি বাদশাহ জহির শাহর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে রোমে চলে যান। ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর তিনি আফগানিস্তানে ফিরে এসে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সরকারের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে প্রেসিডন্ট পদে লড়েন জালমাই রসুল। তবে সফল হননি। জেনেভায় দায়িত্বে থাকা তালেবান–পূর্ব সরকারের কূটনীতিক নাসির আনদিশা আমাকে বলেছিলেন, ‘জালমাই রসুল সম্ভবত আফগানিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে কম বিতর্কিত মানুষ।’

তালেবান–পূর্ব সরকারের অন্য রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এখন কাজ করছেন জালমাই রসুল। দেশের ভবিষ্যতের জন্য নানা পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। লন্ডনে আফগান দূতাবাস থেকে প্রথমবারের মতো নিজের পেশা ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর জবানিতে, ‘আমি একজন রাজনীতিক। আর যেখানেই থাকি না কেন, রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। আপনি জানেন, রাজনীতি একটি রোগের মতো।’ গত মার্চে নাসির আনদিশা জেনেভায় তালেবান–পূর্ব সরকারের ২১ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন। সেখানে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। ওই কাউন্সিলের স্থায়ী কো-চেয়ারম্যান বানানো হয় জালমাই রসুলকে। বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিদের সবাই তালেবানের বিরোধিতা করেন।

লন্ডনে আফগান দূতাবাসটি একটি চার তারকা হোটেলের মতো। সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে জালমাই রসুল সকাল নয়টায় নিচতলায় যান। সেখানে তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলেন দর্শনার্থীদের সঙ্গে। দুপুরে তিনি ওপরের তলায় খাবার খাওয়ার জন্য যান। পরে আবার নিচে নামেন নতুন কিছু হলো কি না, তা জানার জন্য। বেশির ভাগ সন্ধ্যায় তিনি পার্কে হাঁটতে বের হন। আর সপ্তাহে দুবার কাছের একটা মাঠে গলফ খেলতে যান তিনি।

আশরাফ গনি সরকারের পতনের পরের মাসগুলোয় মার্কিন প্রশাসন ও তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা তালেবানের সঙ্গে কাজ করছিল। তারা আফগানিস্তানের মানবিক সমস্যা সমাধান ও সন্ত্রাস দমনে সহায়তা করতে চাইছিল। পরে ২০২২ সালের মার্চে তালেবানের প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নির্দেশে আফগানিস্তানের স্কুলে মেয়েদের পড়াশোনা নিষিদ্ধ করা হয়। এর পর থেকেই নানা নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে তালেবান সরকার। এরপরও তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। জালমাই রসুলসহ তালেবান–পূর্ব সরকারের অন্য কূটনীতিকেরা দেখতে পান, দাপ্তরিক বিভিন্ন আলোচনায় আগের চেয়ে তাঁদের বেশি আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। চলতি বসন্তেই তালেবানের অনুমতিতে কাবুল থেকে লন্ডনে গিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠক করেন হামিদ কারজাই। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে কারজাইয়ের সঙ্গে ছিলেন জালমাই রসুল। সম্প্রতি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকে তালেবানকে ডাকা হয়নি। আর নাসির আনদিশাসহ গনি সরকারের কয়েকজন কূটনীতিক সেখানে কয়েকজন আফগান নারীকে সামনে এনেছেন।

তবে যেসব দূতাবাসে তালেবানের প্রতিনিধি নেই, সেসব দূতাবাসের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার পথে হাঁটেনি তালেবান সরকার। এমনকি জালমাই রসুলও বলেছেন, লন্ডনে আফগান দূতাবাস ভ্রমণ ভিসা, পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি, জন্ম ও বিয়ের সনদ দেওয়াসহ নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। দূতাবাসের দেওয়া এই নথিগুলোর বেশির ভাগেরই স্বীকৃতি দিচ্ছে তালেবান। পশ্চিমা একজন কর্মকর্তা আমাকে বলছিলেন, তালেবান সরকারের অনেক কর্মকর্তা এখনো আগের সরকারের সময়ের পাসপোর্ট দিয়ে ভ্রমণ করছেন। কারণ, বর্তমান সরকারের অধীনে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়নি। আর যদি করাও হয়, তা তেমন একটা কাজে আসবে না। কারণ, কাবুল সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।

আমি জালমাই রসুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তালেবান–পূর্ব আফগান সরকার ব্যর্থ হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ভুল ছিল। আমরা গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে পারিনি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থ কূটনৈতিক প্রয়াসের জেরে দুই বছর আগে কাবুল দখল করে তালেবান। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তালেবানের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার জন্য জালমাই খলিলজাদকে বেছে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে জালমাই খলিলজাদ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আফগানিস্তান, ইরাক ও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালের মে মাস নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর বিপরীতে শর্ত দেওয়া হয়, আফগানিস্তানে আল-কায়েদাসহ অন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের হামলা চালানো ঠেকাবে তালেবান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওই চুক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। পরে ২০২১ সালের এপ্রিলে তিনি ঘোষণা দেন, সে বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্য মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগ করবেন। এরপর এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কাবুল ছাড়েন মার্কিন সেনারা। ক্ষমতা দখল করে তালেবান।

আমি জালমাই রসুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তালেবান–পূর্ব আফগান সরকার ব্যর্থ হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ভুল ছিল। আমরা গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে পারিনি। ঝুঁকি নিয়ে আফগানরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আপনি তা দেখেছেন। তবে আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারও একই পরিণতি হয়েছিল। এতে বড় ভূমিকা রেখেছিল দুর্নীতি।’

এদিকে বিদেশে যেসব আফগান ‘নির্বাসনে’ আছেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে খুবই কম আগ্রহ দেখিয়েছে তালেবান। তবে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি বলেন, ইসলামি আমিরাত আলোচনা চালিয়ে যেতে সব আফগানের জন্য তার দরজা খুলে রেখেছে। দেশ ও দেশের বাইরে আছেন, এমন সবাই আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন। যদি নির্বাসিত কেউ আলোচনা করতে চান, তিনিও দেশে ফিরতে পারবেন।

তবে জালমাই রসুল সেটা করবেন না বলেই মনে হয়। জীবনে তৃতীয়বারের মতো নির্বাসনে তিনি। গত শতকের সত্তরের দশক থেকে তাঁর মতো রাজবংশের রাজনীতিকেরা বড় কঠিন সময় পার করেছেন। কমিউনিস্ট ও ইসলামপন্থীদের হামলার শিকার হয়েছেন। নির্বাসনে থাকা এই রাজবংশের মানুষেরা এখনো আগের দিন ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন। জালমাই রসুল বলেন, তালেবান–পূর্ব সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এখন অনেকে বলছেন, রাজতন্ত্রের সময়ই আফগানিস্তানের জন্য ভালো ছিল। হয়তো অনেকেই মনে করেন, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আফগানিস্তানের জন্য ভালো হবে। জালমাই রসুল অবশ্য নিজে এমন চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত নন। তবে আমি যখন জেনেভায় দায়িত্বে থাকা তালেবান–পূর্ব সরকারের কূটনীতিক নাসির আনদিশার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তিনি অনেকটা ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি আফগানিস্তানের নেতৃত্বের জন্য আমাদের কাউকে বেছে নিতে হয়, আমরা তাঁকে (জালমাই রসুল) বাদশাহ হিসেবে মেনে নেব। এটা অনেক সমস্যার সমাধান করবে।’

লেখা:পুলিৎজারজয়ী লেখক স্টিভ কোল, দ্য নিউইয়র্কার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.