রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাব যে কারণে খারিজ হলো

0
114
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং যখন ইউরোপ সফর করছেন, সে সময় বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনা উত্থাপন করা হলোছবি : রয়টার্স

এ প্রেক্ষাপটের মধ্যেই চীন শান্তি আলোচনার জন্য একটি রূপরেখা প্রস্তাব দিল। কিন্তু সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, সেখানে সবকিছুর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের দায়ী করা হয়েছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র পিপলস ডেইলির অন্তর্ভুক্ত ট্যাবলয়েড দ্য গ্লোবাল টাইমস–এ লেখা হয়েছে, ‘যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে, তার বেশির ভাগটাই নির্ভর করে বিবদমান দুই পক্ষ সংঘাতের শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের কতটা ইচ্ছা পোষণ করে।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যেভাবে এই সংঘাতে নাক গলাচ্ছে, তাতে মীমাংসার পরিবেশ ও ইচ্ছা এখন পর্যন্ত অনেক দূরের বিষয় হয়ে রয়েছে।’

এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও, সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ার আগ্রহ দেখানোর ক্ষেত্রে চীন অন্তত আগ্রহ প্রকাশের দিক থেকে চ্যাম্পিয়ন দেশ। নিঃসন্দেহে এর কারণ হলো, সংঘাতের কারণে গম ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চীন দাবি করেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে অবশ্যই অবাধ বাণিজ্য চলতে হবে।

যা–ই ঘটুক না কেন, চীনের শান্তি প্রস্তাবের চেয়ে ভবিষ্যতে যুদ্ধে চীন জড়িয়ে পড়বে কি না, সেই সম্ভাবনার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়াশিংটন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে রাশিয়াকে অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। মস্কোকে অস্ত্র দিলে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ঘোরতর পরিণতি হবে।

এই যুদ্ধে যেকোনোভাবেই হোক জড়িয়ে পড়া দুই পক্ষের জন্যই অনিশ্চিত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে চেষ্টা করেছে চীন। ইউক্রেনের জন্য উৎকোচ হলো বেইজিং দাবি করেছে, ‘সব দেশের স্বাধীনতা, ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।’ এই দাবির মধ্য দিয়ে বেইজিং যে বিষয়টা স্বীকারের খুব কাছাকাছি চলে গেল তা হলো, রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছে।

সার্বভৌমত্ব বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধরে ইউক্রেন খুব দ্রুত তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চীনে ইউক্রেনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স বলেন, ‘তিনি আশা করেন যে এর মানে হলো চীনারা ‘দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মস্কোর কাছে দাবি জানাবে’।

প্রস্তাবে মস্কোর পক্ষের প্রাপ্তি হলো, বেইজিং যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। সেটা হলে রাশিয়ার ওপর যে সামরিক চাপ তৈরি হয়েছে, তা প্রশমনের একটা সুযোগ তৈরি হবে। কেননা, ইউক্রেনে বড় আকারের সামরিক আগ্রাসনের মাঝপর্যায়ে আছে রাশিয়া।

চীনের এই কূটনৈতিক চাল রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া ঝাখারোভা বলেছেন, চীনের এই পরিকল্পনার অর্থ হলো ‘ইউক্রেনে পশ্চিমারা যে অস্ত্র ও ভাড়াটে সৈন্যের জোগান দিচ্ছে, তা বন্ধ হওয়া।’ তিনি আরও বলেন, এই পরিকল্পনার অভিপ্রায় হলো, ‘হিংসার অবসান, ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরে যাওয়া, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে যে নতুন সীমানার বিন্যাস তৈরি হয়েছে, তার স্বীকৃতি প্রদান এবং ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নাৎসিমুক্ত করা ও ইউক্রেন ভূখণ্ড থেকে যে ধরনের হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তার অপসারণ।’

চীনের প্রস্তাবে এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন কোনো পক্ষকেই দায়ী করা হয়নি। এর পরিবর্তে, সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য সাধারণভাবে পশ্চিমকে ও বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে খোলামেলা সমালোচনা করা হয়েছে।

একটি অঞ্চলের নিরাপত্তা কখনোই সামরিক জোট শক্তিশালী করা কিংবা সামরিক জোট সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে অর্জিত হয় না। চীনের কূটনৈতিক নথিতে দাবি করা হয়েছে ইউক্রেনকে ধাপে ধাপে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল পশ্চিমের।

যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেছে চীন। কূটনৈতিক নথিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও সর্বোচ্চ চাপ সমস্যা সমাধান করতে পারবে না, শুধু নতুন সমস্যা তৈরি করবে।’

যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত ও বৈরীভাবেই চীনের এই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যান বলেন, যুদ্ধ খুব দ্রুত বন্ধ হতে পারে যদি রাশিয়া চীনের প্রথম দাবিটি ‘সব দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন’ মেনে নেয়।

সুলিভ্যান যুক্তি দেন, রাশিয়ায় হামলা করতে যায়নি ইউক্রেন। ন্যাটোও রাশিয়াকে আক্রমণ করতে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে আক্রমণ করতে যায়নি। এটা পুতিনের বেছে নেওয়া একটি যুদ্ধ।’

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইউরোপ সফরের সময়সূচি থেকেও ইঙ্গিত মিলছে রাশিয়ার প্রতি চীনের পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি। তিনি মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন কিন্তু কিয়েভে গিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেননি।

যা–ই ঘটুক না কেন, চীনের শান্তি প্রস্তাবের চেয়ে ভবিষ্যতে যুদ্ধে চীন জড়িয়ে পড়বে কি না, সেই সম্ভাবনার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়াশিংটন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে রাশিয়াকে অস্ত্র দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। মস্কোকে অস্ত্র দিলে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ঘোরতর পরিণতি হবে।

ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, সমরাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র দিতে অন্তত মনস্থির করেছে বেইজিং। ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যের সারাংশ হলো, শান্তির কথাও বলছে আবার ইউক্রেন আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে অস্ত্র দিতেও মনস্থির করছে, চীন আসলে দুভাবে খেলছে।

ওয়াশিংটন থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন চীনের অস্ত্র সরবরাহ পরিকল্পনার গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করার কথা চিন্তা করছে। তারা আশা করছে, এতে বেইজিং এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে যে তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি নতুন করে ভাববে।

পুতিনকে যদি বেইজিং অস্ত্র সরবরাহ করে তাহলে চীন ইরানের মতো রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্রে রূপান্তরিত হবে। রাশিয়াকে বড় পরিসরে অস্ত্র দেওয়ার সামর্থ্য চীনের আছে। সংক্ষেপে, ইউক্রেনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক শিবির এবং চীনের নেতৃত্বে আরেক শিবির নীতিহীন প্রক্সি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

  • ডেনিয়েল উইলিয়ামস ওয়াশিংটন পোস্টের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রতিনিধি
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.