রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ, শঙ্কায় পায়রাও

0
86
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র

দেশের কয়লাভিত্তিক বড় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন নিয়ে আবারও টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। সময়মতো ডলার না পাওয়ায় কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার অভাবে দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ হয়ে আছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। ডলার না পেলে উৎপাদন বন্ধ হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রায়ও। আর এতে বাড়তে পারে লোডশেডিং।

গত ডিসেম্বরে একটি ইউনিট উৎপাদনে আসার পর এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানায় নির্মিত বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৫ এপ্রিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চার দিন পর এটি আবার চালু হয়। কিন্তু কয়লার অভাবে ২৪ এপ্রিল থেকে এটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আমদানি করা কয়লার জাহাজ আগামীকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ বলেন, ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কয়লার জাহাজ চলে আসবে মঙ্গলবার। এরপর দুই দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে।

শাহ্ আব্দুল মওলা কেন্দ্র ব্যবস্থাপক, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র

চুক্তির প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি। কিন্তু কয়লার অভাবে ১৪ জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। মূলত ডলার-সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এক মাস পর আবার উৎপাদনে ফেরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দিনে ৫ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন। এক জাহাজ কয়লা এনে এক সপ্তাহের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সচল রাখা যায়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, দেশে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এখন দেশের অনেক এলাকায় প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে পিডিবিকে জানাতে হয়। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন সূচির সঙ্গে তা সমন্বয় করে পিডিবি। পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার  বলেন, কয়েক দিনের মধ্যের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তবে কবে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। 

সাঈদ একরাম উল্লাহ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিআইএফপিসিএল

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট আছে। দ্বিতীয় ইউনিট আগামী জুনে চালুর কথা রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট চালু হলে দিনে ১০ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। বর্তমানে তাদের ৬ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ দেওয়া আছে। নতুন করে ডাকা দরপত্রে অংশ নিয়ে আরও ৬০ লাখ টন কয়লার ক্রয়াদেশ পেয়েছে দেশের একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ। শুরু থেকে তারাই কয়লা সরবরাহ করছে এই কেন্দ্রে। ৬০ লাখ টন কয়লা দিয়ে আগামী তিন বছর রামপাল কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হচ্ছে এসব কয়লা।

২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় নেওয়া হয় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। ২০১২ সালে গঠিত হয় বিআইএফপিসিএল। ২০১৩ সালে পিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয় ওই কোম্পানির। ২০১৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটি হয় ২০১৭ সালে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রটির। কিন্তু বারবার শুধু সময় পিছিয়েছে। সুন্দরবনের কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা।

উৎপাদন বন্ধের শঙ্কায় পায়রা

১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ সরবরাহের দিক থেকে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসি) এটি নির্মাণ করে। ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একই সমস্যায় পড়েছে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।

বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

বিসিপিসি সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে কয়লার টাকা বকেয়া রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালিয়ে আসছে তারা। গত জানুয়ারিতে কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি। এরপর মজুতকৃত কয়লা দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রটি। এমন পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারিতে কিছু ডলারের ব্যবস্থা করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কেন্দ্রটির উৎপাদন সচল থাকে। এখন নতুন করে বকেয়া বিলের চাপে পড়েছে কেন্দ্রটি।

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে একই বছরের ২৬ আগস্ট। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি করে পিডিবি। সঞ্চালন লাইনের জটিলতায় দেড় বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। এরপর বিকল্প উপায়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এখন অবশ্য ঢাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে কেন্দ্রটি।

গত তিন বছরে এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি বলে জানান পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা (কেন্দ্র ব্যবস্থাপক) শাহ্ আবদুল মওলা। তিনি বলেন, টাকা পরিশোধ করে কয়লা কিনতে হয়। এরপরও ডলারের সংকট থাকায় ৬ মাস পর পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা-ও এখন বিল দেওয়া যাচ্ছে না। মজুত কয়লা দিয়ে এ মাস হয়তো কোনোরকমে চালানো যাবে। এর মধ্যে ডলার না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.