আনিকা কবির শখ
২০১১ সালের দিকে টেলিভিশন নাটকের তুমুল জনপ্রিয় একজন তারকার নাম ছিল আনিকা কবির শখ। বিজ্ঞাপনচিত্রেও তাঁর ছিল দাপুটে বিচরণ। জনপ্রিয়তার কারণে পরিচালকেরা তাঁকে নিয়ে কাজ করতে চাইতেন বেশি। অভিযোগ ছিল, শখও তাঁর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করতেন। শুটিং সেটে দেরিতে আসতেন। কখনো কখনো আসতেনই না। তেমনই এক ঘটনার কারণে তাঁকে নিষিদ্ধও হতে হয়। ২০১১ সালের দিকে এনটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘এফএনএফ’-এর শুটিং সময়ে শিডিউল নিয়ে জটিলতা তৈরির কারণে শখকে নিয়ে পরিচালক রেদওয়ান রনি কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর তিন বছর তাঁকে নিয়ে কোনো নাটকের কাজ করেননি রনি। একপর্যায়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখপ্রকাশ করায় দীর্ঘদিন পর শখকে ‘পরিবার করি কল্পনায়’ নাটকে কাস্ট করেন রনি।
সেই নাটকের শুটিং সময়েও শখ শিডিউল নিয়ে জটিলতা তৈরি করেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে শিডিউল ফাঁসানোর দায়ে দ্বিতীয়বার শখকে নিষিদ্ধ করেন রেদওয়ান রনি। তখন শিডিউল ফাঁসানোর গুরুতর অভিযোগের কথা গণমাধ্যমের কাছেও জানিয়েছিলেন রনি। তিনি বলেছিলেন, ‘এনটিভিতে প্রচার চলতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক “পরিবার করি কল্পনায়”র পূর্বনির্ধারিত শুটিংয়ের তারিখ ছিল ২৬ মার্চ। কিন্তু শখের দেখা নেই, পরিচালকের ফোনও রিসিভ করছেন না তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং করছেন অন্য ইউনিটে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে সহকারী পরিচালকের মেসেজে শখ কনফার্ম করেছেন ২৬ মার্চ শুটিংয়ের কল টাইম অনুযায়ী সকাল ১০টায় তিনি শুটিং স্পটে আসবেন। কিন্তু আসেননি শখ।’
প্রসূন আজাদ
শুটিং ইউনিটে কথা-কাটাকাটি, পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস, অভিযোগ দাখিল, গণমাধ্যমের সংবাদ—সবকিছুর কারণে ২০১৬ সালে নিষিদ্ধ হন লাক্স তারকা প্রসূন আজাদ। নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী রোকেয়া প্রাচীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের অক্টোবরে নাটকের তিন সংগঠন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন প্রসূন। ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক তখন জানিয়েছিলেন, ‘পরিচালক রোকেয়া প্রাচীর অভিযোগের ভিত্তিতে ডিরেক্টরস গিল্ড প্রসূনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিন দিনের সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। কিন্তু তিন দিন ২৮ অক্টোবর শেষ হলেও এর মধ্যে কোনো যোগাযোগ করেননি প্রসূন। বরং তাঁর ফেসবুক থেকে খুব আপত্তিকর স্ট্যাটাস আসে, যা এই ইন্ডাস্ট্রির সবার জন্য খুবই লজ্জার। এটা সংগঠনকে অবমাননা, অশ্রদ্ধা ও গুরুত্বহীন ভাবা। এ কারণে আগামী এক বছর ডিরেক্টরস গিল্ডের কোনো সদস্য তাঁকে নিয়ে প্রোডাকশন তৈরি করতে পারবেন না।’
‘স্বপ্ন সত্যি হতে পারে’ নামের একটি নাটকের শুটিংকে কেন্দ্র করে নির্মাতা ও প্রযোজক রোকেয়া প্রাচীর সঙ্গে অভিনেত্রী প্রসূন আজাদের কথা-কাটাকাটি হয়। পরে দুজনই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এর জেরে প্রসূন আজাদের বিরুদ্ধে ১৯ অক্টোবর রোকেয়া প্রাচী অভিযোগ করেন নাটকের তিন সংগঠনের কাছে। তারপরই কারণ দর্শানোর নোটিশ যায় প্রসূন আজাদের কাছে। তিন দিনের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হলেও প্রসূন কোনো জবাব দেননি। তারপরই তিন সংগঠন মিলে এই সিদ্ধান্ত নেয়।
সারিকা সাবরিন
মডেল হিসেবে বেশ আলোচিত ছিলেন সারিকা। প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ—এসব নিয়ে একাধিকবার খবরের শিরোনামে এসেছিলেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় শিডিউল ফাঁসানোর মতো অভিযোগও আসে তাঁর বিরুদ্ধে। তারই ফলস্বরূপ, ২০১৮ সালের ৩ আগস্ট মডেল ও অভিনেত্রী সারিকা সাবরিনকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে টিভি নাটকের সংগঠন ‘টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’। ওই সময়ে এই অভিনেত্রী কোনো নাটক, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপনসহ সমিতির কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রযোজক মোহাম্মদ বোরহান খানের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৮ জুলাই টেলিপ্যাবের সালিস বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে সংগঠনের কার্যকরী কমিটিতে পাস হয় সিদ্ধান্তটি। সালিস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেলিপ্যাবের সভাপতি মামুনুর রশীদ, সাধারণ সম্পাদক ইরেশ যাকের, সালিস বৈঠকের আহ্বায়ক তারেখ মিন্টুসহ অনেকেই।
২০১৮ সালে মডেল ও অভিনেত্রী সারিকার বিরুদ্ধে অভিযোগে প্রযোজক বোরহান খান বলেছিলেন, ‘গত ২১ মার্চ বেশ কয়েকটি নাটকের শুটিং নিয়ে নেপালে যান তাঁরা। সারিকার পাঁচটি এক ঘণ্টা ও সাত পর্বের একটি ধারাবাহিকে কাজ করার কথা ছিল। পারিশ্রমিক হিসেবে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা, বিমানের রিটার্ন টিকিট ও চিত্রনাট্যগুলো তাঁর বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু যাওয়ার দিন সারিকা আর বিমানবন্দরে আসেননি। এরপর সারিকাকে ছাড়াই আমরা নেপালে যাই। পরে আরেকজন শিল্পীকে ঢাকা থেকে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার।’ ছয় মাস নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেছিলেন, ‘এ ধরনের বিশৃঙ্খলা করেও ফোন ধরেননি, চিঠির কোনো উত্তরও দেননি সারিকা। বাধ্য হয়েই আমাদের এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।’
অ্যালেন শুভ্র
শখ, সারিকা ও প্রসূন আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রায় একই রকম হলেও অ্যালেন শুভ্রর নিষিদ্ধ হওয়ার অভিযোগটি ছিল একেবারে ভিন্ন। তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালক নিয়াজ মাহবুবের গায়ে হাত তোলার মতো গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়। পরিচালকের সঙ্গে এ ধরনের অসদাচরণের অভিযোগে ২০১৮ সালে তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অ্যালেন শুভ্রকে। ২০১৮ সালে এপ্রিলে ডিরেক্টরস গিল্ড, অভিনয় শিল্পী সংঘ ও টেলিভিশন প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অভিযোগকারী পরিচালক নিয়াজ মাহবুব তখন বলেছিলেন, মাস ছয়েক আগে তাঁর নাটক ‘গুরাগুরি’র (আঞ্চলিক শব্দ) শুটিংয়ে বরিশালে গিয়েছিলেন অ্যালেন শুভ্র। সেখানে তিন দিন কাজ করার কথা থাকলেও তিনি দুই দিনে কাজ শেষ করতে বলেন। পরিচালক রাজি না হলে অ্যালেন ওই অবস্থায় ঢাকায় চলে আসেন। এর সপ্তাহখানেক পর অনেক কথাবার্তায় কাজটি করে দিয়ে নতুন করে পারিশ্রমিক দাবি করেন। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে নির্মাতা বলেন, বরিশালে শুটিং শেষ করতে না পারায় তাঁর অনেক লস হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে তাঁর বক্তব্য, ওখানকার সব শিল্পীকে ঢাকায় আনতে হয়েছে। এরপরও যদি সম্ভব হয় তাহলে অভিনেতাকে টাকা দেবেন। এর মধ্যে অ্যালেন নাকি ফোন করে নির্মাতাকে গালিগালাজ করেন। মাস দুয়েক আগে ঢাকার মগবাজার এলাকায় দেখা হলে নির্মাতাকে ইট দিয়ে আঘাত করেন অভিনেতা।
এই ধরনের ঘটনার পরপরই নিয়াজ মাহবুব অভিযোগ করেন নাটকের সংগঠনগুলোর কাছে। গত ৪ এপ্রিল টেলিভিশন নাটকের তিন সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড, অভিনয় শিল্পী সংঘ ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নিয়াজ মাহবুব ও অ্যালেন শুভ্রকে হাজির করে। দুজনের কথা শোনার পর অ্যালেন তাঁর কৃতকর্মের কথা উপস্থিত সবার সামনে স্বীকার করেন। এরপর তিন সংগঠন মিলে অ্যালেন শুভ্রকে তিন মাসের জন্য সব ধরনের শুটিংয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
জেবা জান্নাত
অসহযোগিতা ও অসদাচরণের অভিযোগে উঠতি মডেল জেবা জান্নাতকে ‘নিষিদ্ধ’ করে টেলিভিশন নাটক নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। নিষিদ্ধের খবর প্রকাশ্যে আসার পর নাট্যনির্মাতা সাজ্জাদ দোদুলের বিরুদ্ধে ‘অনৈতিক’ প্রস্তাবের অভিযোগ তোলেন এই মডেল। অভিযোগ অস্বীকার করেন সাজ্জাদ দোদুল। গত বছরের মার্চের দিকে রাশেদা আক্তারের ‘টু লেট’ নামের একটি সিরিয়ালে কাজ করেন জেবা। অক্টোবরে ডিরেক্টরস গিল্ডে জেবার বিরুদ্ধে শিডিউল ফাঁসানোর অভিযোগ করেন রাশেদা আক্তার। তাঁর অভিযোগ, জেবার অসহযোগিতার কারণে নাটকটি শেষ করতে পারেননি তিনি, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ডিরেক্টরস গিল্ডের অভিযোগ নিষ্পত্তির উপকমিটির আহ্বায়ক ফিরোজ খান জানান, জেবার বক্তব্য জানতে সালিস ডাকা হলেও তিনি আসেননি। পরে ৯ জানুয়ারি সাধারণ সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে তাঁকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১০ জুন জেবা জান্নাতকে নিষিদ্ধের চিঠি পাঠিয়েছে ডিরেক্টরস গিল্ড, ২০ জুন থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। চিঠির খবর প্রকাশ্যে আসার পর পরিচালক রাশেদা আক্তারের স্বামী, পরিচালক সাজ্জাদ দোদুলের বিরুদ্ধে ‘অনৈতিক প্রস্তাব’ দেওয়ার অভিযোগ তোলেন গণমাধ্যমে। জেবা জান্নাত জানান, ঘটনাটি এক বছর আগের। নিষিদ্ধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিজেও বুঝছি না আমি কেন নিষিদ্ধ হলাম।’জেবা তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানান, রাশেদা আক্তার লাজুকের স্বামী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন দোদুল তাঁকে বাজে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করার কারণেই তাঁর পেছনে লেগেছেন তাঁরা। জেবার সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্মাতা সাজ্জাদ হোসেন দোদুল।
রুকাইয়া চমক
রুকাইয়া জাহান চমকের অভিনয় ক্যারিয়ার খুব বেশি দিনের নয়। এর মধ্যে অভিনয় নিয়ে তিনি যতটা না আলোচনায় এসেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি এসেছিলেন সহকর্মী অভিনয়শিল্পী আরশ খানের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অভিযোগ এনে। চমকের এই অভিযোগ থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। একইভাবে চমকের বিরুদ্ধে শুটিং সেটে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও আসে। চমকের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের সমাধানে এগিয়ে আসে নাটকের সংগঠনগুলো। ১৩ আগস্ট নাটকের তিন সংগঠন সৃষ্ট জটিলতার নিরসনে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে প্রমাণিত হয়, চমকের অভিযোগের সত্যতা নেই। উল্টো চমকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা মেলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে উপস্থিত সবার সামনে ক্ষমাও চেয়েছেন চমক।
একইভাবে চমকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিচালককে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকারও করেন তিনি। এদিকে ১৩ আগস্টের সেই রায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি নাটকের পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। ২১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালকদের এই সংগঠন ঘোষণায় জানায়, তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ চমক, যা আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এদিকে ডিরেক্টরস গিল্ডের এই সিদ্ধান্ত মানেননি বলে জানিয়েছেন চমক।