সাত বছর আগের কথা। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে দেশজুড়ে ১০ লাখ তালগাছের চারা আর ৩৫ লাখ আঁটি রোপণের উদ্যোগ নেয় সরকার। পরিচর্যা না থাকায় কোথাও মরে যায় তালের চারা, কোথাও হয়েছে নষ্ট। আর আঁটি থেকেও গজায়নি চারা। প্রায় শতকোটি টাকা গচ্চাতেই শেষ হয় তালগাছ প্রকল্পের গল্প।
আগাম সমীক্ষা ছাড়াই তালগাছের সে আয়োজন যে পুরোটাই নিষ্ফলা ছিল, খোদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানও টের পেয়েছেন। তবে দেরিতে, শতকোটি টাকা জলে যাওয়ার পরে। তিনি বলছেন, ‘৩৮ লাখের মতো তালের চারা-আঁটি লাগানোর পর দেখা গেল, যত্নের অভাবে মারা যাচ্ছে। তাই এটি বাতিল করে দিয়েছি। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। ফলে এটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে হচ্ছে না।’
এরপর ২০১৭ সালে বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানতে ৬৮ কোটি টাকা খরচায় দেশের আট স্থানে বসানো হয় রাডার (লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর)। বলা হয়েছিল, ১৫ মিনিট আগেই ওই এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাবে। তবে সেটাও সফলতার মুখ দেখেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি প্রযুক্তি চালু করে। এর মাধ্যমে ৫৪ ঘণ্টা আগেই বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যাওয়ার কথা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষক ও জেলেদের কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এটি খুব বেশি কাজে লাগবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।
এদিকে, তালগাছ প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর গত বছর নতুন করে হাওরাঞ্চলে আরও দুটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্প দুটির সফলতা নিয়ে এখনও আশাব্যঞ্জক তথ্য মেলেনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার আরও একটি প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত মার্চে স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপশন অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি রিডাকশন (রিভার)’ শীর্ষক প্রকল্প পাস হয়েছে। সেই প্রকল্পেও ১ হাজার ৪০০টি বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করার কথা বলা আছে।
বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে এভাবে একের পর এক প্রকল্প ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও থামছে না মৃত্যুর মিছিল। এ মৌসুমে এখনও পুরোদমে শুরুই হয়নি ঝড়-বাদলা। এর মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবারও বজ্রপাতে ছয় জেলায় আরও আটজনের জীবন নিভেছে। এর আগে গত ২৩ এপ্রিল এক দিনেই ১০ জনের মৃত্যু হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ভৌগোলিক অবস্থান, সচেতনতার অভাব, উঁচু গাছ কাটাসহ নানা কারণে বছর বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যই বলছে, এক যুগে এ সংখ্যা তিন হাজারে ঠেকেছে। আর প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত এ বছরের প্রথম চার মাসে মারা গেছেন ৮৯ জন।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ, দেশে মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর– এই ৯ মাসে হয় বজ্রপাত, তবে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত হয় সবচেয়ে বেশি। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুনে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিকাজের সময় ৭০ শতাংশ, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় এবং গোসল কিংবা মাছ ধরার সময় জলাশয়ে ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের শঙ্কা ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। বার্ষিক প্রাণহানির এই সংখ্যার বিচারে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। মৃত্যুর সংখ্যা বিচার করে ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
শতকোটি টাকা গচ্চা
২০১৬-১৭ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ তালগাছের চারা ও ৩৫ লাখ আঁটি রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমীক্ষা ছাড়াই কর্মসূচি হাতে নেওয়া এবং দেখভালের অভাবে ওই প্রকল্পের প্রায় শতকোটি টাকা জলে গেছে।
তালগাছ রোপণ প্রকল্পের আওতায় রংপুরের আট উপজেলার ছয়টিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তালগাছের চারা রোপণ করা হয় ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬৭টি। এখন এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। অযত্ন-অবহেলায় এসব গাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ও বাজিতপুরে ২০১৭ সালে লাগানো হয় পাঁচ হাজার তালের আঁটি। এর বেশিরভাগ থেকেই চারা গজায়নি। আর যে কিছু আঁটির চারা হয়েছে, সেগুলোও দেখভালের অভাবে নষ্ট হয়েছে। বরিশালের হিজলার হরিনাথপুর, মেমানিয়া, ধুলখোলা, বরজালিয়া ও গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নে প্রায় ১৫ হাজার তালের চারা লাগানো হয়েছিল। এসবেরও এখন কোনো অস্তিত্ব নেই।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক স্থানে তালগাছ রোপণ না করেই বিল তোলা হয়েছে। দেশের বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ একটি। ২০১৮ সালে এক লাখ ও ২০২২ সালে ৫০০ তালগাছ সুনাগমগঞ্জে রোপণ করা হয়েছে বলে কাগজে দেখানো হলেও এসব গাছের অস্তিত্ব নেই। সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মৃণাল কান্তি দাসের দাবি অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি তালগাছ লাগানো এলাকা বুড়িস্থল-আলমপুর সড়কে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে একটি তালগাছও নেই। স্থানীয় ইউপি সদস্য সাখাওয়াত হোসেন রাজিম বলেন, রোপণ করার আগে মাটি তালগাছ উপযোগী কিনা, তাও পরীক্ষা করা হয়নি।
দুই মন্ত্রণালয়ের একই রকম প্রকল্প
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের হাওরাঞ্চলের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি (শেল্টার) নির্মাণ করা হচ্ছে। ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামে এ প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। একেকটি ছাউনি নির্মাণে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা লাগছে। এসব ছাউনিতেও বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জীবনের সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ২৩১ কোটি টাকা। এর আওতায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলার ৫৮ উপজেলায় ১০০ থেকে ১২০ বর্গমিটার ব্যাসার্ধের ১৬টি আর্লি স্টিমার ইমিটার (ইএসই) নামে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হচ্ছে। পাশাপাশি ‘আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সল্যুশন’-এর মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ, ভয়েস ও খুদেবার্তার আকারে স্থানীয়দের সতর্কবার্তা দেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জের ছয় উপজেলায় এরই মধ্যে ২৪টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছিল। এর মধ্যে ছয় উপজেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক জাকির হোসেন জানান, তাঁরা একটি বিশেষ প্রকল্প থেকে বড় হাওরে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮ ফুট উঁচু তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র করেছেন। আরও ১২টির নির্মাণকাজ চলছে। এগুলো বজ্রপাত ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বর্ষাকালে বিশুদ্ধ পানির জন্য এবং দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার জন্য কাজে আসবে।
রাজশাহী অঞ্চল দেশের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলাটিতে ১৮টি বজ্রনিরোধক দণ্ড ও বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, কোনো ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) যন্ত্রগুলো কিনে নিজেরাই স্থাপন করেছে। এসব যন্ত্রের কারিগরি মান ও কার্যকারিতা যাচাই ছাড়াই দুটি কোম্পানিকে দিয়ে যেনতেন করে স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ এসব যন্ত্র। বজ্রপাত গবেষক আশরাফ দেওয়ান বলেন, বর্ষায় সারাদেশেই কমবেশি বজ্রপাত হয়, আর বর্ষার শেষে পাহাড়ি এলাকায় বজ্রপাত হয় বেশি। এ পরিস্থিতি মাথায় রেখে প্রকল্পগুলো করা হয়েছে কিনা, তা দেখতে হবে। সেটা না হলে আগের মতো অনেক টাকা অপচয় হবে। আর বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনোটাই টেকসই হচ্ছে না। কোনটা যথার্থ হবে– তা পরীক্ষামূলক ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে; অন্যথায় অর্থ অপচয় হবে। এ কারণে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে টেকসই প্রকল্প দরকার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ১৩৫ উপজেলায় মোট ৩৩৫টি বজ্রনিরোধক দণ্ড ও বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে। বজ্রপাত-নিরোধক দণ্ড ও যন্ত্র স্থাপন করার পর প্রাণহানি হলে বোঝা যাবে, এটা কার্যকর নয়। প্রাণহানি না হলে বোঝা যাবে, সেটি কাজ করছে। পুরোপুরি সব জায়গায় স্থাপনের পর সব জেলার তথ্য পেলে আমরা বলতে পারব, কতটা সুফল পাচ্ছি।
জাহিদুর রহমান, ঢাকা ও পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ