মূল্যস্ফীতি কমানোর খুব বেশি উদ্যোগ নেই

0
179
জাহিদ হোসেন

দেশে মূল্যস্ফীতি চড়া, ডলারের সংকট চলছে। এই সময়ে যেসব বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। বাজেটের মাধ্যমে যে ধরনের সংস্কারের সুযোগ ছিল, তা-ও নেই। সামষ্টিকভাবে বাজেটটি সম্প্রসারণমূলক। কারণ, বাজেটে ঘাটতি প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। সেটা চলতি অর্থবছরের চেয়ে অনেক বেশি। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে (এডিপি) বরাদ্দের কাছাকাছি। এডিপি বিশাল, বাজেট ঘাটতিও বিশাল।

বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে পরিকল্পনা দেওয়া হলো, তা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গেও মিল নেই। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে, এ জন্য মোবাইল ফোন, কলম—এসব সামগ্রীর ওপর কর বসানোর বিকল্প ছিল না।

সম্প্রসারণমূলক বাজেট ভালো কি মন্দ, এটা নির্ভর করে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতির ওপর। যদি এখন আগের মতো ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) থাকত, তাহলে এই বাজেট অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক হতো। কিন্তু আমরা পুরো উল্টো পরিস্থিতিতে আছি। মূল্যস্ফীতি মাসের পর মাস ৯ শতাংশের ওপরে, ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত অর্থবছরে ৭০০ কোটি ডলার ও চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

রিজার্ভ সঠিকভাবে হিসাব করলে ব্যবহারযোগ্য হবে ২ হাজার কোটি ডলারের মতো; যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের চেয়ে বেশ কম। এখন যেমন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তা স্বাভাবিকভাবে রিজার্ভ বাড়বে, এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই। এই অবস্থায় সম্প্রসারণমূলক বাজেট মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

বাজেটে বাস্তবতা কম, স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি

বাজেট ২০২৩–২৪
বাজেট ২০২৩–২৪

মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ওপর এই বাজেট ঘাটতি কতটা চাপ ফেলবে, তা নির্ভর করছে ঘাটতি কোথা থেকে মেটানো হবে তার ওপর। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির বড় অংশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নতুন অর্থবছরেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতির জন্য ভয়ংকর হবে। যদি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার এই টাকা ধার নেয়, তাতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কম হবে। এখন স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদও ৮ শতাংশের মতো। ব্যাংকাররা এটা পছন্দ করবেন, কারণ এটা নিরাপদ বিনিয়োগ। এখন ডলার-সংকটের কারণে বিনিয়োগ চাহিদা কম, কিন্তু চাহিদা একেবারেই নেই, এটা ঠিক নয়। ব্যাংকের টাকা ব্যবসায় গেলে কর্মসংস্থান হতো, যা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখত। আবার ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। অনেক ব্যাংকে আমানত কমেছে। ডলার কেনার কারণে অনেক টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে গেছে। এই অবস্থায় সরকার যদি বাজেটের ঘাটতির ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো থেকে নেয়, তাহলে সেই টাকা বিনিয়োগের বাইরে থেকে গেল।

এর চেয়ে বড় গোঁজামিল আর হতে পারে না

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেনছবি: বাসস

রাজস্ব ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন ছিল, তা-ও হচ্ছে না। সরকার অনেক দিন ধরে বলে আসছে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের দিকে যেতে চায়। অর্থমন্ত্রী প্রত্যক্ষ করের অংশ ৩৫ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে নিতে চান।

ব্যাংকের টাকা ব্যবসায় গেলে কর্মসংস্থান হতো, যা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখত। আবার ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। অনেক ব্যাংকে আমানত কমেছে।

কিন্তু যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, তাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতাই বেশি। ফলে যা বলা হচ্ছে, আর যা করা হচ্ছে, তা এক নয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে পরিকল্পনা দেওয়া হলো, তা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গেও মিল নেই। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে, এ জন্য মোবাইল ফোন, কলম—এসব সামগ্রীর ওপর কর বসানোর বিকল্প ছিল না। এর ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে। এই বাজেটে খুব কম সুবিধা আছে, যাতে মূল্যস্ফীতি কমবে। এ জন্য এই বাজেট দুঃসময় উপযোগী হয়নি।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালে প্রত্যক্ষ করে সুবিধা দেওয়ার কারণে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশের সমপরিমাণ লোকসান হয়েছে। যদিও এটাকে আইএমএফ দেখে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে। আর অর্থমন্ত্রী দেখছেন ভর্তুকি হিসেবে।

প্রত্যক্ষ করে যে ছাড় দেওয়া হয়, তা কর ন্যায্যতার পরিপন্থী। আইএমএফ এটা বাতিল বা কমিয়ে দেওয়ার পক্ষে। প্রত্যক্ষ করে ছাড় দেওয়ার কারণে যে রাজস্ব আয় কম হচ্ছে, এটা আদায়ের উদ্যোগ নিলে ভালো হতো।

জাহিদ হোসেন সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ঢাকা কার্যালয়, বিশ্বব্যাংক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.