বিএনপি এখন কী করবে

0
76
বিএনপির দলীয় পতাকা।

দেশজুড়ে বিএনপি নেতাকর্মীর নামে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক মামলা; গ্রেপ্তারে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। দলের মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারাবন্দি করা হচ্ছে। নেতাদের বাসায় বাসায় চলছে পুলিশি হানা। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় ও গুলশান কার্যালয়ে ঝুলছে তালা।

পুলিশি পাহারায় থাকা কার্যালয় দুটিতে যাচ্ছে না নেতাকর্মী। সব মিলিয়ে সরকার পতনের এক দফা চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি।
একই সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি কঠোর হাতে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলার হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন তিনি। মহাসমাবেশ ও হরতালের পর টানা তিন দিন সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে ‘চাপে’ ফেলতে গিয়ে উল্টো এখন নিজেরা ‘বিপদে’ পড়েছে।

রকারের এ কঠোর অবস্থানকে মোকাবিলা করতে এখন কী করবে বিএনপি? রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ‘আক্রমণাত্মক’ অবস্থান থেকে চাপমুক্ত হয়ে তারা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারকে কি বাধ্য করতে পারবে? নাকি আবারও ২০১৪ সালের মতো বিএনপিকে ছাড়াই সরকার একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটবে? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সামনে এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। ‘ডু অর ডাই’ অবস্থানে রয়েছে তারা। চলমান চূড়ান্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখবে। আরও কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচির ছক কষছে দলটি। টানা তিন দিনের অবরোধ শেষে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবার নতুন কর্মসূচি নিয়ে আসছে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী ৩৭ দল। শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে রোববার থেকে দেশজুড়ে আবার টানা রাজপথ-রেলপথ-নৌপথে অবরোধের পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচিও দিতে পারে তারা।

জানা গেছে, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার টানা কর্মসূচি দেবে, নাকি সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে মাঝে একদিন বিরতি দেবে– তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আজ বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির কারাগারের বাইরে থাকা সদস্যসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এর আগে  গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মত নেওয়া হবে।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, তিন দিনের অবরোধে সারাদেশের রাজপথ বন্ধ করার ব্যাপারে সফল হয়েছে বলে মনে করেন তারা। সামনে সারাদেশের সঙ্গে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি ঢাকার রাজপথও অচল করার চেষ্টা করবে বিএনপি। একই সঙ্গে তাদের গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের দমনপীড়নের বিপক্ষে দেশ-বিদেশে গণতান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে সরকারের ওপর পাল্টা চাপ বাড়াতেও চেষ্টা করবে বিরোধী দলগুলো।

এ ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী গতকাল বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার চরম স্বৈরশাসকের অবস্থানে চলে গেছে। ১৯৭২ সালের মতো আবারও একদলীয় শাসনের দিকে তারা। পৃথিবীর ভয়াবহ স্বৈরশাসকরা যে পথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করেছে; সে পথেই হাঁটছে সরকার। তবে আমরা গণতান্ত্রিক আদর্শের লড়াই থেকে পিছপা হবো না। এ আন্দোলন থামবে না। আরও মামলা হবে, খুন করবে, গ্রেপ্তার করবে। তবে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে চলমান কঠোর আন্দোলন আরও কঠোর হবে। এবার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বিএনপি নেতারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে আন্দোলনের সব পথ পেরিয়ে বর্তমান চূড়ান্ত আন্দোলনে এসেছেন। দেশের প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে যুক্ত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষও। আন্তর্জাতিক শক্তিও তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সাদরে গ্রহণ করেছে। সর্বশেষ সাতটি দেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। এটা সরকারের জন্য একটি বড় শর্ত।

দলটির নীতিনির্ধারক নেতাদের মতে, এ শর্ত পূরণ না করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অংশীদার দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে আওয়ামী লীগকে। যেখানে দেশের অর্থনীতি ও ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করছে, সেখানে বিদেশি অর্থনৈতিক অংশীজনের সঙ্গে দ্বিমত করলে তার পরিণতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে টিকে থাকা কঠিন হবে।

বিএনপির নেতাদের আশা, এ রকম একটি কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার আত্মঘাতী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো মাঠও ছাড়বে না। গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সমর্থক বিশ্বের চাপের পাশাপাশি তারাও রাজপথে শক্ত অবস্থানে থাকবে। বিএনপি নেতাকর্মীর আর হারানোর কিছু নেই। মাথায় শত শত মামলা নিয়ে ঘরে থাকতে পারছেন না, বাইরেও থাকতে পারছেন না। ১৫ বছর ধরে তারা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হতে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার সংগ্রাম করে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করে ঘরে ফেরার প্রত্যয় তাদের।

বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন গতকাল বলেন, কোনো জেল-জুলুমের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন দমানো যাবে না। বিএনপির মহাসমাবেশ, হরতাল ও অবরোধে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বিএনপির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার অত্যাচার-নির্যাতন করে আর টিকে থাকতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ইতোমধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ দেখে সরকারকেই দোষারোপ করছে এবং সংযত আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।

মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘাতের অভিযোগে কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতার নামেই মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ আড়াই হাজারের মতো নেতাকর্মী। মহাসমাবেশের পর থেকে মামলা হয়েছে অর্ধশতাধিক। এখনও দেশজুড়ে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন নেতারা। দপ্তরের দায়িত্বে থাকা দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ প্রতিদিন বিকেলে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলন করছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যরাসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা গাঢাকা দিয়ে আছেন।

টানা তিন দিনের অবরোধ মোকাবিলায় পাল্টা রাজপথে পাহারায় থাকছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ-র‍্যাবের পাশাপাশি বিজিবিও। অবরোধে মহাসড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল প্রায় বন্ধ থাকলেও রাজধানীতে কিছুটা কম হলেও চলছে। জনজীবনও প্রায় স্বাভাবিক।

আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঝটিকা মিছিল করছেন। রাজপথে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে পারছেন না। তবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তের হাতে কিছু যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার জন্য সরকারের তরফ থেকে বিএনপি নেতাকর্মীকে দায়ী করা হলেও অস্বীকার করেছে তারা। পাল্টা ক্ষমতাসীন দলকে এসব নাশকতার জন্য দায়ী করছে বিএনপি।

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকার হত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন ও দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। আমরাও সর্বাত্মক কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনে আছি। জনগণও সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছে। মানুষ জেগে উঠেছে। এবার আর একতরফা নির্বাচন হতে দেবে না।

জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা করে বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার অবরোধ শেষে আবারও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। নতুন কর্মসূচিও চলমান কর্মসূচির মতোই হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.