ঢাকায় আড়াই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে ৪৯২টি মামলা।
২৭৫টি মামলার তদন্ত শেষ। ১১৬টিতে চালক শনাক্ত হয়নি। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ায় স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে বাস করতেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। কোনাপাড়া থেকে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন এই আইনজীবী। গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি বেলা একটার দিকে কোনাপাড়া বাজারে অবস্থানকালে পেছন থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হন তিনি। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর।
ইকবালের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অজ্ঞাতপরিচয় চালককে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন তাঁর ভাই মাহাবুবুর রহমান। প্রায় এক বছর ধরে তদন্ত করে পুলিশ সেই অটোরিকশার চালককে শনাক্ত করতে পারেনি। তাই মামলাটিতে সম্প্রতি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের এমন মৃত্যুর ঘটনায় ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে চালককে শনাক্ত করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
দেখা গেছে, গত আড়াই বছরে ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হয়েছে ৪৯২টি, যার ২৭৫টির তদন্ত শেষ। মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী গাড়িচালকদের শনাক্ত করতে না পেরে ১১৬টি মামলায় পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অবশ্য ১৫৯টি মামলায় পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে শনাক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষক ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালককে শনাক্ত করতে না পারা উদ্বেগজনক। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা সম্ভব হয় না। এর ফলে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়। চালকেরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই রক্ষা পাবেন বলে ভাবতে শুরু করেন।
চালককে যদি শনাক্ত করা না যায়, তাহলে যানবাহনের নিবন্ধনব্যবস্থা, চালকের লাইসেন্স ব্যবস্থা, শহরজুড়ে ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা বসানোর সুফল কী, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘একটি দেশের রাজধানীতেই যখন ৪২ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী চালক শনাক্ত হন না; বিচারের আওতার বাইরে থেকে যান; তখন নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার বিষয়টি অধরাই থেকে যাবে।’ তিনি বলেন, যে নগরের রাস্তাঘাট, অলিগলিতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে, সেখানে গাড়িচাপা দিয়ে যাঁরা মানুষ মারবেন, তাঁদের শনাক্ত করা কিংবা ধরা যাবে না, সেটি অস্বাভাবিক ঘটনা।
মামলা বেশি যাত্রাবাড়ীতে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা মহানগরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২২ সালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৩ জনে।
ঢাকার সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত আড়াই বছরে ঢাকা মহানগরে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায়। সংখ্যা ৬৬। পুলিশ ৩৬টি মামলায় চালক শনাক্তে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য ১১টি মামলায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। ১৯টি মামলার তদন্ত চলমান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে খিলক্ষেত থানায়—৩১টি। এর মধ্যে ৬টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ। এর বাইরে শাহবাগ থানায় ২৮টি, পল্টন থানায় ২২, ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ১৯টি করে, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৭, মতিঝিল থানায় ১৪, হাতিরঝিল থানায় ১৩, শ্যামপুর থানায় ১২, বনানী থানায় ১০ এবং বিমানবন্দর থানায় ১০টি মামলা হয়েছে। বাকি মামলাগুলো হয়েছে অন্য থানায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনাসহ দক্ষিণবঙ্গের ২৪টি জেলার যানবাহনের রাজধানীতে প্রবেশপথগুলো যাত্রাবাড়ী থানার মধ্যে পড়েছে। থানাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া না গেলে শেষ পর্যন্ত আর ঘাতক গাড়ি কিংবা চালককে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।’
দায়সারা তদন্তের অভিযোগ
আইনজীবী ইকবাল নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মুকিত হাসান দাবি করেন, অনেক চেষ্টা করেও তিনি ঘাতক চালককে শনাক্ত করতে পারেননি।
অবশ্য মামলার বাদী ইকবালের ভাই মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ চাইলে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে পারত। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থলের কোনো সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেনি। দায়সারা তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। শিগগিরই আদালতে প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেব।’
ঢাকার পোস্তগোলা সেতুর পূর্ব পাশে গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রিকশাচালক আলাউদ্দিনকে ধাক্কা দিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় একজন চালক পালিয়ে যান। এ ঘটনায় শ্যামপুর থানায় মামলা হয়। মামলাটি পাঁচ মাস তদন্ত করেও পুলিশ চালককে শনাক্ত করতে না পেরে গত ২ মে ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। শ্যামপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘রিকশাচালক আলাউদ্দিনের মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে শনাক্তের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যায়নি।’
অবশ্য আলাউদ্দিনের স্ত্রী হাজেরা বিবি বলেন, ‘পুলিশ চেষ্টা করলে চালককে ধরতে পারত। কিন্তু পুলিশ কাউকে ধরল না। মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথাও জানায়নি।’
ময়মনসিংহের বাবু মিয়া নামের একজন রিকশাচালক স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে ঢাকার ভাটারায় বাস করতেন। গত বছরের ১২ অক্টোবর রাত সাড়ে নয়টার দিকে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ-১–এর এক নম্বর ফটকের সামনের সড়ক পার হওয়ার সময় বাবু মিয়া, তাঁর ছেলে ও স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যান অজ্ঞাত এক প্রাইভেট কারের চালক। পরে বাবু মিয়া হাসপাতালে মারা যান। বাবুর ছেলে শুভর বাঁ পা ভেঙে যায়। স্ত্রী সুমি আক্তারের ডান পা ভেঙে গেছে। এ ঘটনায় খিলক্ষেত থানায় মামলা হয়েছে। তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত ঘাতক চালককে শনাক্ত করতে পারেনি।
মামলার বাদী নিহত বাবু মিয়ার পিতা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছিল, সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজ পুলিশ পেয়েছে। কিন্তু চালককে পুলিশ ধরতে পারল না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ সুলতান আলী বলেন, ‘ঘটনাস্থলের একটা সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া গেলেও গাড়িটির নম্বর শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, গাড়িটির নম্বরপ্লেট দেখা যায়নি।’
ডিএমপির মামলা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (মনিটরিং সেল) প্রতি মাসে হত্যা, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণের মামলার তদন্ত অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। এই তালিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মামলা নেই।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন গত ২৯ মে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় কিছু কিছু মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কতগুলো মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
‘চাইলে’ পারে পুলিশ
কোনো ধরনের সিসিটিভি ফুটেজ অথবা সূত্রহীন মামলায় গভীর তদন্ত করে আসামি শনাক্ত করেছে পুলিশ, এমন উদাহরণ অনেক। যেমন গত বছরের ৫ জুলাই রাত একটার কিছু পর বাড্ডার প্রগতি সরণিতে কনটেইনারবাহী একটি যানের ধাক্কায় নিহত হন ইয়াহিয়া ও ইসরাফিল নামের দুই ব্যক্তি।
৯ মাস তদন্ত করে কনটেইনারবাহী যানের চালককে শনাক্ত করে গত ২৭ মার্চ চালক নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক নুর ইসলাম শিকদার। তিনি বলেন, চালকের নাম–ঠিকানা জোগাড় করতে দীর্ঘদিন লেগে ছিলেন। পরে চালককে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
পুলিশেরই কেউ কেউ মনে করেন, তদন্ত কর্মকর্তারা চাইলে ও লেগে থাকলে আসামি শনাক্ত করা সম্ভব। তবে দুর্ঘটনার মামলায় তদন্তে জোর দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোখলেসুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মামলা যদি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়, ঘটনার পেছনে লেগে থাকা হয়, তাহলে ঘাতক চালককে ধরা কঠিন নয়।
‘এটা ভাবাই যায় না’
রাজধানীতেই যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামি শনাক্ত করা সম্ভব না হয়, তাহলে ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি কী তা সহজেই অনুমেয়।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সামছুল হক বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যেসব চালক দায়ী, তাঁরা শনাক্ত হবেন না কিংবা বিচারের মুখোমুখি হবেন না; এটা ভাবাই যায় না।’ তিনি বলেন, একজন চালক যদি অপরাধ করেও বিচারের আওতার বাইরে থেকে যান, সে ক্ষেত্রে চালক আরও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করবেন। আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।