পাখি দেখতে আফ্রিকার জঙ্গলে

0
113
কালামাথা গনোলেক—আফ্রিকার জঙ্গলে খুব সহজেই দেখা মেলে

পূর্ব আফ্রিকার ছোট্ট দেশ রুয়ান্ডা। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সে দেশের কিগালি শহরে বসেছিল বিশ্বের বড় এক সংরক্ষণ সম্মেলন। প্রায় ৯০টি দেশের সংরক্ষণবিদদের নিয়ে বসেছিল মিলনমেলা। বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করতে সম্মেলনে যোগ দিই ২২ জুলাই। দিনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় বিভিন্ন সভা আর অনুষ্ঠানে। তবে সকালে পাখি দেখার মতো বেশ কিছুটা সময় হাতে ছিল। সুযোগটা খুব ভালোভাবে কাজে লাগালাম শহরের আশপাশের কয়েকটি জঙ্গল ঘুরে।

২৫ জুলাই কম্বোডিয়ান বন্ধু সাইমন তাঁর গাড়ি নিয়ে আমার হোটেলে এসে হাজির হলেন খুব ভোরে। সাইমন এক বছর ধরে কিগালি শহরে বাস করছেন। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন পাখিগবেষক হিসেবে।

কিগালি শহরের খুব কাছেই একটি ইকোপার্কে নিয়ে গেলেন। পার্কটির নাম ‘নাইয়ানডুনগো আরবান ওয়েটল্যান্ড ইকোপার্ক’। দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার। পার্কটিতে ঢুকতেই আরও বেশ কয়েকজন পাখি দেখিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁরা আমাদের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের বিখ্যাত বন্য প্রাণী গবেষক বিবেক মেনন, সুইস বিজ্ঞানী টমাস ব্রুকনসহ বিভিন্ন দেশের পাখিপ্রেমীরা।

লালমাথা মৌটুসি—অসাধারণ এই পাখির দেখা মেলে আফ্রিকার প্রায় সব জঙ্গলেই
লালমাথা মৌটুসি—অসাধারণ এই পাখির দেখা মেলে আফ্রিকার প্রায় সব জঙ্গলেই

আফ্রিকার জঙ্গলের প্রতিটি পাখির রং আর রূপ দারুণ মনোমুগ্ধকর। সকালের আলো ফোটার আগেই দেখা পেলাম একেবারেই রঙিন এক পাখির। পেটের নিচটা টকটকে লাল আর পিঠের অংশ কুচকুচে কালোয় অসাধারণ এক সংযোজন। পাখিটির নাম ‘কালামাথা গনোলেক’। সাতসকালে এ রকম একটি পাখির দেখা পেয়ে ভাবলাম, আজ হয়তো অনেক পাখির দেখা পাব।

ঠিক তা–ই হলো। যেদিকেই তাকাই, শুধু পাখি আর পাখি। পার্কটির ভেতর এক লম্বা খুঁটিতে বসে থাকতে দেখলাম ঝুঁটিয়াল এক ইগলকে। মাথাজুড়ে অদ্ভুত এক ঝুঁটি। পাখির বই ঘেঁটে তার নাম খুঁজে বের করলাম। আফ্রিকায় ইগলটির দেখা সহজেই মিললেও আমার কাছে একেবারেই নতুন। ইগলটির নাম ‘লম্বা ঝুঁটির ইগল’। মাথার ওপর আরও দুই জাতের ইগল ঘুরতে দেখলাম। হাতের কাছেই একটি ঝুপড়ি গাছের ভেতর পেয়ে গেলাম ‘মেটে ঘাড় ফিসকাল’। খুব কাছাকাছি গিয়ে পাখিটির ছবি তুললাম। তবে সে বিরক্ত হলো না।

পাখি দেখতে দেখতে পার্কটির বিভিন্ন গাছপালা দেখেও অভিভূত হলাম। বিরল সব গাছের সমারোহ আছে এখানে। ছোট ছোট ঘাসবনে বিভিন্ন জাতের ঘাসপাখির সঙ্গে কয়েক জাতের মুনিয়া, বাবুই ঘোরাঘুরি করছিল।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি জলাশয় চোখে পড়ল। এসব জলাশয়ে সহজেই দেখা পেলাম বেশ কয়েক জাতের গুড়গুড়ি ও পানকৌড়ি। জলাশয়ের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম ‘আফ্রিকান রাজহাঁস’। সকালের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক সারস পাখি। নাম তার ‘গ্রে ক্রাউন ক্রেন’। আফ্রিকায় এসে এই পাখির দেখা পাওয়ার ইচ্ছে সবারই থাকে।

মেটে ঘাড় ফিসকাল—আফ্রিকার জঙ্গলে সহজলভ্য।
মেটে ঘাড় ফিসকাল—আফ্রিকার জঙ্গলে সহজলভ্য।

পার্কটির যেদিকেই তাকাই, বুনো ফুলে ভরা। সে ফুলের চারপাশে দেখা পেলাম পাঁচ জাতের মৌটুসির। একটি মৌটুসির সঙ্গেই প্রায় আধা ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। পাখিটির নাম ‘লালমাথা মৌটুসি’। সকালের পাখি দেখার এ আয়োজনে সবচেয়ে বিরল যে পাখিটির দেখা পেলাম, তার নাম ‘হোয়াইট কলার্ড অলিভব্যাক’। প্রথমে পাখিটিকে দেখতে অনেক কষ্ট হলো। জঙ্গলের মধ্যে আবছা দেখা পেলাম। খানিক পর পাখিটি একটি তারের বেড়ায় এসে বসল। কিছুটা সময় পেলাম ছবি তুলতে।

তিন ঘণ্টায় ৬৬ জাতের পাখির দেখা পেলাম। বেশির ভাগ প্রজাতিই জীবনে প্রথমবার দেখা। এত কম সময়ে যে একটি জঙ্গলে এত পাখি দেখা যায়, ভাবতেই অবাক লাগে! হালকা রোদ বাড়তে থাকলে পার্কের ভেতর একটি কফির দোকানে গেলাম। গরিলা কফি এখানকার খুবই বিখ্যাত। এক মগ কফি হাতে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম শহরের দিকে। আফ্রিকার ছোট্ট এক জঙ্গলে দারুণ এক সকালের কথা সারা জীবন মনে থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.