ভয়েজার ১ উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করে এর সহোদর ভয়েজার ২। নভোযান দুটি ইতিমধ্যে মহাকাশে কাটিয়েছে ৪৬ বছর, পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমানা। এই দুই সহোদরের ৪৬ বছরের অভিযানের এক সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান…
১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন যখন চাঁদের বুকে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেন, তখন পৃথিবীতে টিভি সেটের সামনে বসে সে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছিল প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। ঘটনাটা এতই অভিনব যে সে সময়কার অনেকেই ঠিক ওই মুহূর্তে কোথায় বসে ছিল, কী করছিল, তা মনে রেখেছেন আজীবন। রোমাঞ্চকর এই অভিযানের পরও পেরিয়ে গেছে বহু বছর। আরও কয়েক দফায় চাঁদে মানুষ পা ফেললেও সশরীরে মহাকাশে যাওয়ার প্রয়োজন অনেকটাই ফুরিয়েছে আকাশজয়ের স্বপ্ন পূরণ হওয়ায়। তবে একের পর এক মহাকাশযান পাঠিয়ে আকাশের গ্রহ-উপগ্রহে মানুষের আবিষ্কারের নেশা তারপরও পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ নেশার উৎস আসলে প্রোথিত হাজার বছরের মানবসভ্যতার শুরুতেই। যখন কোনো একজন আদি মানব আকাশে তাকিয়ে বলেছিলেন, কী আছে মেঘের ওপারে? মেঘের ওপারে কী আছে সে আমাদের জানা হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে সূর্যের সীমা ছাড়িয়ে দূর মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন গত শতাব্দীর মাঝামাঝিও কেউ দেখতে সাহস পেত না হয়তো। কিন্তু আমরা সে সাফল্যই অর্জন করেছি ভয়েজার মিশনের মাধ্যমে। ভয়েজার ১ নামের রোবট মহাকাশযানটি সূর্যের সীমা ছাড়িয়েই এখন ছুটে চলেছে অনন্ত নক্ষত্রবীথির পানে। ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যাত্রার ৪৬ বছর পূর্ণ করা এই মহাকাশযানকে বলা যায় আরেক সঙ্গী ভয়েজার ২-এর সহোদর। ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করা এই মহাকাশযানেরও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে ৪৬ বছর। তাই দুই সহোদরের ৪৬ বছরের অভিযানের এক সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান দেখে নেওয়া যেতে পারে।
ভয়েজারের কাব্যিক উপাখ্যানের শুরুতেই স্মরণ করতে হবে জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গ্যারি ফ্লান্দ্রোর কথা। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার, তিনি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আবিষ্কার করেন যে সত্তরের দশকে একটা সময় সৌরজগতের ভারী গ্রহগুলো, যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন এমন এক অবস্থানে আসবে, যার মহাকর্ষ শক্তি ব্যবহার করে দূর মহাকাশে পাঠানো যাবে মহাকাশযান। এ এমন এক অভিনব অবস্থান, যা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আবারও ১৭৫ বছর।
আসলে যখন পৃথিবী থেকে কোনো মহাকাশযান অন্য গ্রহে পাঠানো হয়, তখন সাহায্য নেওয়া হয় স্লিংশটের। স্লিংশট হলো অন্য গ্রহ বা উপগ্রহের মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশযানের গতি বাড়িয়ে নেওয়া, যা তৈরি করে দেয় সীমিত জ্বালানি ব্যবহার করে দূরের পথে মহাকাশযান পাঠানোর সুযোগ। এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে নাসার বিজ্ঞানীরা বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহতে অভিযান চালানোর এক দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা করলেন। নাসার আগের গ্রহান্তরে মহাকাশযান পাঠানোর প্রোগ্রামের নাম ছিল মেরিনার প্রোগ্রাম। তাই এই অভিযানের জন্য পরিকল্পনা করা দুই মহাকাশযানের নাম দেওয়া হলো মেরিনার ১১ ও মেরিনার ১২। কিন্তু কিছুদিন কাজ করার পর তাঁরা আবিষ্কার করলেন, এই অভিযানে ব্যবহূত প্রযুক্তি এত বেশি উৎকর্ষ লাভ করছে যে আলাদা নামেই হতে পারে এ অভিযান। তাই নতুন করে এ দুই মহাকাশযানের নাম দেওয়া হলো ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২।
১৯৭৭ সালে যখন যাত্রা শুরু করে, তখন ভয়েজার মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহস্পতি ও শনি গ্রহে অভিযান করা। কিন্তু এই মিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিজ্ঞানীরা আরও বেশি কিছু চিন্তা করলেন। মিশন শেষ করে আশি সালে ভয়েজার ১ মহাশূন্যের পথে যাত্রা করলেও ভয়েজার ২-এর যাত্রাপথ রিপ্রোগ্রাম করে কিছুটা বদলে দিলেন। ফলে ভয়েজার ২ ইউরেনাস ও নেপচুনের গ্রহের পথে অভিযানে এগিয়ে চলল। এই মহাযাত্রায় দুই সহোদর মহাকাশযান ৪টি গ্রহ, ৪৮টি উপগ্রহ, তাদের চৌম্বকক্ষেত্র এবং বলয় পর্যবেক্ষণ করে সৌরজগত্ সম্পর্কে আমার জানার পরিধি বিস্ময়করভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ যাত্রার মাহাত্ম্য বোঝাতে অনেক কথাই বলা যায় এখন। কিন্তু শুরুতে এত বেশি আশা করেননি এর ডিজাইনাররাও। প্রথমে এই মিশনের কার্যকাল ধরা হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর। তারপর তা বৃদ্ধি করে করা হয় ১২ বছর। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড, ৪৬ বছর পরও স্বমহিমায় মহাকাশযান দুটি ছুটছে অসীমের পানে।
ভয়েজার ২ যখন পাঠানো হয়, তখন এমনভাবে তা পাঠানো হয়েছিল, যাতে পরবর্তী সময়ে চাইলে ইউরেনাস ও নেপচুন যোগ করা যায় এর যাত্রাপথে। ১৬ দিন পরে পাঠানো ভয়েজার ১-এর গতিপথ ছিল সে হিসেবে কিছুটা ছোট। বৃহস্পতিতে তাই ভয়েজার কিছুদিন আগে ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ পৌঁছে যায়।
বৃহস্পতির মাত্র কয়েক লাখ কিলোমিটার ওপর দিয়ে উড়ে যায় ভয়েজার ১। ভয়েজার ১-এর পাঠানো ছবি থেকে জানা যায় বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বয়ে চলা বিশাল বিশাল ঝড়ের কথা। আরও চমৎকৃত হতে হয়, যখন এর পাঠানো তথ্যেই জানা যায় সৌরজগতের মুকুট শনির বলয়ের মতো বলয় আছে বৃহস্পতিরও। তবে এ দফায় সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য ছিল বৃহস্পতির সবচেয়ে ভেতরের উপগ্রহ আইয়ো সম্পর্কে। গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা চারটি গ্যালিলিয়ান উপগ্রহের একটি এই উপগ্রহ আইয়োতে দেখা যায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীর বাইরে প্রথমবারের মতো জানা যায় আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব। শুধু তা-ই নয়, পর্যবেক্ষণ করা ৯টি আগ্নেয়গিরির কোনোটার গতি ছিল এত বেশি যে তার লাভা পৌঁছে যাচ্ছিল ৫০০ কিলোমিটার ওপরে।
সালফারের আধিক্য থাকা এই লাভার উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের নতুন চিন্তার খোরাক দিয়েছিল আশির দশকে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রায় ৪০০ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আবিষ্কৃত হয়েছে এই উপগ্রহে, এটি পেয়েছে সৌরজগতের সবচেয়ে সক্রিয় ভূপ্রকৃতির মর্যাদা।
ভয়েজার ২ বৃহস্পতির কাছে পৌঁছায় ওই বছরের ৯ জুলাই। আইয়োর বাইরে এ দুই মহাকাশযান পর্যবেক্ষণ করে বৃহস্পতির অপর দুই বৃহত্ উপগ্রহ গ্যানিমিড ও ইউরোপা। এই দুই উপগ্রহের বরফাচ্ছাদিত ভূপৃষ্ঠে এদের পাঠানো ছবিতে দেখা যায় অনেক দাগের অস্তিত্ব। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসেন, এই দুই উপগ্রহের বরফের নিচে রয়েছে কোনো তরল পদার্থের সাগরের।
সৌরজগতের সবচেয়ে বৃহত্ গ্রহ বৃহস্পতির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দুই ভয়েজার পৃথিবীতে পাঠায় প্রায় ৩৩ হাজার ছবি, যা সৌরজগত্ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অনেক ধারণাই বদলে দেয়। বিশাল এ গ্রহের পরে মহাকাশযানদ্বয় উড়ে চলে শনি গ্রহের পানে।
যদিও সৌরজগতের মুকুট বলে পরিচিত সুন্দর বলয়ধারী গ্রহ শনিতে এর আগে পাইওনিয়ার ১১ অভিযান চালিয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তারপরও এই গ্রহের বিস্তারিত জানতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়েজার ১-এর পৌঁছানো পর্যন্ত। ভয়েজার ১ পৌঁছে প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে পাঠায় শনির বলয়ের হাই রেজুলেশন ছবি। এ সময় ভয়েজার ১ শনির সবচেয়ে বড় উপগ্রহ টাইটানের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায়। এ সময় আবিষ্কার করে টাইটানের বায়ুমণ্ডল মূলত তৈরি পৃথিবীর মতো নাইট্রোজেন দিয়ে। তবে এই বায়ুমণ্ডল এত বেশি ঘন ছিল যে এর নিচে কী আছে, তখন জানা যায়নি। এ জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে এই শতাব্দীর শুরুতে শনির কক্ষপথে ক্যাসিনির পৌঁছানো পর্যন্ত।
ভয়েজার এ সময় আরেকটি তথ্য জানায়। শনির একদম ওপরের বায়ুমণ্ডলে রয়েছে হিলিয়ামের উপস্থিতি, ঠিক যেমনটা বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন। একই সঙ্গে জানা যায়, খুব ধীরগতিতে ওপরের হিলিয়াম শনির কেন্দ্রের দিকে ডুবে যাচ্ছে।
ভয়েজার ১-এর ৯ মাস পরে ২৫ আগস্ট ১৯৮১ সালে শনির কাছে পৌঁছায় ভয়েজার ২ মহাকাশযান। শনি গ্রহের মাত্র ৪১ হাজার কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যাওয়া ভয়েজার ২-এর পর্যবেক্ষণে জানা যায় আরও সব চমকপ্রদ তথ্য। ভয়েজার ১ ও ২-এর পর্যবেক্ষণে জানা যায়, শনির বরুফে উপগ্রহ এন্সেলেডাসের উষ্ণপ্রস্রবণের কথা, যা পরে ক্যাসিনির অভিযানে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া এ দুই সহোদর মহাকাশযান শনি গ্রহের উত্তর মেরুতে চলতে থাকা ষড়্ভুজাকৃতির বিশাল ঘূর্ণির অস্তিত্বও আবিষ্কার করে।
শনি গ্রহ অভিযান শেষে ভয়েজার ১ ও ২-এর যাত্রাপথ আলাদা হয়ে যায়। ভয়েজার ১-এর এরপর আর কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না। ছিল শুধুই মহাশূন্যের পানে ছুটে চলা। ওদিকে ইঞ্জিনিয়াররা ভয়েজার ২-কে একটা স্লিংশট ব্যবহার করে এমন পথে চালিত করেন, যাতে তা ছুটে যায় ইউরেনাস আর নেপচুনের দিকে। ইউরেনাস ও নেপচুনের কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র মহাকাশযান ভয়েজার ২। ভয়েজার ২-এর পাঠানো ছবিগুলোই শুধু এই দুই গ্রহের কাছ থেকে তোলা ছবি আমাদের কাছে।
১৯৮৬ সালের ২৪ জানুয়ারি, ভয়েজার ২ উড়ে যায় ইউরেনাসের ওপর দিয়ে। মাত্র ৮০১,৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে। ইউরেনাসের ঘূর্ণন অন্য গ্রহগুলো থেকে একটু ব্যতিক্রমধর্মী। সব উপগ্রহ কক্ষের ওপর দাঁড়িয়ে ঘুরলেও ইউরেনাস ঘোরে সূর্যের দিকে মুখ করে। অর্থাৎ, ইউরেনাসের ঘূর্ণন অক্ষ সূর্যের দিকে মুখ করা। অতীতে কোনো একসময় বড় কোনো সংঘর্ষের দরুন এমন গতির সৃষ্টি হয়েছিল। অদ্ভুত ঘূর্ণনের ইউরেনাসের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়েজার ২ আবিষ্কার করে ইউরেনাসের চৌম্বকক্ষেত্র। ভয়েজার ২-এর মাধ্যমেই জানা যায় ইউরেনাসেরও রয়েছে বলয়। এ ছাড়া এই গ্রহের অনেকগুলো উপগ্রহের হদিসও পাওয়া যায় এই মিশনে।
অনেকগুলো উপগ্রহ আবিষ্কৃত হলেও সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল ইউরেনাসেরই উপগ্রহ মিরান্ডা আবিষ্কার। মিরান্ডার পৃষ্ঠে বিশাল বিশাল গর্ত, খালের ছবি পাঠায় ভয়েজার ২। এমনকি কোনো কোনোটার গভীরতা ছিল ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত! গবেষকেরা ধারণা করেন, অতীতে কখনো মিরান্ডা হয়তো ভেঙে চুরমার হয়েছিল, তারপর আবার আকর্ষণে জোড়া লেগে এই অবস্থা হয়েছে।
ভয়েজার ২-এর মহাযাত্রায় শেষ স্টপেজ ছিল নেপচুন। ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট নেপচুনের ওপর দিয়ে উড়ে যায় ভয়েজার ২। এ সময় মহাকাশযানটি পৌঁছে গিয়েছিল নেপচুনের উত্তর মেরুর ৪ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। এই যাত্রায় যেকোনো বস্তুর সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল এটি। যেহেতু এটাই ছিল শেষ গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য, তাই নাসা এত কাছ দিয়ে পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সময় নেপচুনের যে নীল ছবিটি তোলা হয়, তা এখন পর্যন্ত এই গ্রহের সবচেয়ে প্রচারিত ছবি। নীল মারবেলের মতো দেখতে এই ছবি সবার কাছেই এক স্নিগ্ধ অনুভূতি এনে দেয়।
নেপচুনের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়েজার ২ আবিষ্কার করে যে সৌরজগতের যেকোনো জায়গার তুলনায় নেপচুনের বায়ুর গতি বেশি, বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় তা অন্তত তিনগুণ বেশি। এ যাত্রায়ই নেপচুনের সঠিক ভর হিসাব করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া এ সময় নেপচুনের ছয়টি নতুন উপগ্রহের কথা জানা যায়। আবিষ্কৃত হয় নেপচুনের বলয়ও। তবে নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনের বিদ্ঘুটে সব আচরণ আবিষ্কারও ছিল চমক-জাগানিয়া। ট্রাইটন এমনকি নেপচুনের গতিপথকেও প্রভাবিত করে। অন্য সব উপগ্রহের চাইতে ট্রাইটনের গতিও পাওয়া যায় উল্টো দিকে। যার দরুন বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ট্রাইটন মূলত কুইপার বেল্টের কোনো বস্তু, যা নেপচুনের মহাকর্ষে কোনো একসময় বাঁধা পড়েছিল। ট্রাইটনকে পেছনে রেখে ভয়েজার ২-ও এরপর বেরিয়ে পড়ে শূন্যতার পথে যাত্রায়, ভয়েজার ১-এর মতো। শূন্যতার পথে যাত্রা করলেও এই দুই মহাকাশযানই এরপরও বিজ্ঞানে অবদান রেখে চলছে গত ৪০ বছর ধরে।
পরের কথা বলার আগে এক লাইনে সূর্যের হেলিওস্ফিয়ারের কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। সূর্য তার চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে আয়নিত প্লাজমা কণা। এই কণা একটা গোলকের মতো তৈরি করছে। এর বাইরে বুদ্বুদের মতো একটা অংশ বাধা দিচ্ছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্য তারা থেকে আসা মহাজাগতিক প্লাজমাকে। বুদ্বুদের মতো এই অংশের নাম হেলিওপজ। বিজ্ঞানীরা এর আগে এই ব্যবস্থার কথা অনুমান করেছেন। কিন্তু এই বুদ্বুদের অস্তিত্ব ঠিক কতদূরে, তার কোনো হিসাব জানা ছিল না। তবে এই অঞ্চলকেই ধরা হয় সূর্যের আওতাভুক্ত অঞ্চল, অর্থাৎ সৌরজগতের সীমানা। যেহেতু এই সীমার দূরত্ব জানা ছিল না, তাই ভয়েজার ১ কখন পৌঁছাবে শেষ সীমায়, তা আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছিল না। তবে ভয়েজার ১ যখন এই অংশে পৌঁছে যায়, তখন তা থেকে আসা সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে ভয়েজার ১ পৌঁছে গেছে আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে। অর্থাৎ সূর্য এবং অন্যান্য তারার মাঝে যে মহাশূন্য, সেখানে। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট হেলিওপজ পেরিয়ে মানব নির্মিত প্রথম কোনো বস্তু পেরিয়ে যায় সৌরজগতের সীমা। এ অর্জন অবশ্যই অসামান্য।
এই মুহূর্তে ভয়েজার ১-এর অবস্থান পৃথিবী থেকে ২ হাজার কোটি কিলোমিটারেরও বেশি। তারপরও কিন্তু ভয়েজারের অভিযান থেমে নেই। প্রতিনিয়ত এ যোগাযোগ করে চলেছে পৃথিবীর সঙ্গে। ভয়েজার ১-এর ট্রান্সমিটার ২৩ ওয়াট শক্তির সিগন্যাল পাঠায় পৃথিবীর দিকে। এর শত শত কোটি ভাগের এক ভাগও পৌঁছায় না পৃথিবীতে। কিন্তু এই অল্প সিগন্যালই সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতে পারে নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক। এমনকি পৃথিবী থেকে পাঠানো সিগন্যালও গ্রহণ করতে পারে ভয়েজার মহাকাশযান।
এবার কিছু ভবিষ্যতের কথা বলা যাক। প্রায় ৩০০ বছরের মধ্যে ভয়েজার ১ পৌঁছাবে দূরবর্তী উর্ট মেঘের কাছে। এটা হলো সৌরজগতের চারপাশ ঘিরে বিশাল বরুফে মেঘ, যেখানে উৎপন্ন হয় ধূমকেতু। তারপর এই বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় সৌরজগতে। তবে দুঃখজনক হলো, উর্ট মেঘে পৌঁছানোর অনেক আগেই ভয়েজার ১-এর পাওয়ার সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাবে।
ভয়েজারের শক্তির জোগান দেয় এতে থাকা তেজস্ক্রিয় রেডিও আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর। কয়েক বছরের মধ্যে এই জেনারেটরের শক্তি এতটাই কমে যাবে যে তা আর যন্ত্রপাতিগুলো চলাতে সক্ষম থাকবে না। মহাকাশযানের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকা জাইরোস্কপিক সিস্টেমও তখন আর কাজ করবে না। তথ্য সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণের সিস্টেমও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে তার আগে নাসা শক্তি বাঁচাতে একটার পর একটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সুইচ অফ করে দেবে পৃথিবীতে বসেই। ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভয়েজারের জেনারেটর আর এমন কোনো বিদ্যুত্ উৎপাদন করতে পারবে না, যা দিয়ে কোনো যন্ত্রপাতি সচল রাখা যাবে। তাই পাঁচ বছরের মিশন বেড়ে ৪৬ বছর সচল থাকার পরও হয়তো ৫০ বছর হওয়ার মতো ভাগ্যবান আমরা হব।
তারপর? তারপর উর্ট মেঘের মধ্য দিয়ে নিঃসঙ্গ যাত্রা। এ যাত্রা চলবে হয়তো টানা ৩০ হাজার বছর। ৪০ হাজার বছর পরে গিয়ে ভয়েজার ১ পৌঁছাবে গোলিয়াথ ৪৪৫ নক্ষত্রের কয়েক আলোকবর্ষের মধ্যে। তবে এতেই কিন্তু শেষ নয়। কারণ, ভয়েজার মহাকাশযানদ্বয় উভয়ে বহন করছে দুটি একইরকম ‘গোল্ডেন রেকর্ড’। এই গোল্ডেন রেকর্ডে ধারণ করা আছে পৃথিবীর বিভিন্ন শব্দ ও ছবি। দেওয়া আছে মানবসভ্যতার কিছু নিদর্শন। নির্দেশ করা আছে বিভিন্ন পালসারের অবস্থানের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান। এ যেন পালসারের পথনির্দেশে এক ম্যাপ। রেকর্ডের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া আছে তা চালানোর নির্দেশনাও। এই রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে স্বর্ণ দিয়ে। তার ওপর দিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউরেনিয়াম-২৩৮, যাতে গোল্ডেন রেকর্ডের বয়স কত হলো তা বিশ্লেষণ করা যায় গোল্ডেন রেকর্ড থেকেই। কারণ, ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর অর্ধজীবন শতকোটি বছর।
ভবিষ্যতে কি সত্যিই কোনো বুদ্ধিমান কোনো এলিয়েনের হাতে পড়বে এই গোল্ডেন রেকর্ড? আমরা জানি না। তবে আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে মানুষের। অসীমের মধ্যে বেঁচে থাকাই তো মানুষের চিরদিনের স্বপ্ন। তবে কেউ গোল্ডেন রেকর্ড না পেলেও মানুষের কীর্তি ভয়েজারে করে বেঁচে থাকবে শতকোটি বছর। কারণ, এ রেকর্ড এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে শতকোটি বছর পরেও চালানো যাবে তা।
ভয়েজার মিশনের দুই রোবট, মানুষের তৈরি সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তু এবং সৌরজগতের বাইরে পৌঁছা মানবনির্মিত একমাত্র বস্তু আমাদের সবার বার্তা অসীমে নিয়ে যাচ্ছে, এ কথা ভাবলেই তো কেমন শিহরণ হয়। ৪৬ বছরের এই মহাকাব্যিক যাত্রা তাই আমাদের আশাবাদী করে। আমাদের গৌরবকে বাড়িয়ে দেয় শতগুণ। বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের ক্ষুদ্র অবস্থানকে মনে করিয়ে দেয়। তবে তা আমাদের খাটো করে না, বরং বিশাল মহাবিশ্বের অংশ হতে পারার গৌরব অনুভব করতে দেয়।
লেখক: ইবরাহিম মুদ্দাসসের,
সূত্র ও ছবি: নাসা
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট ২০১৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়