ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশও

0
103

দেশের ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তীব্র কম্পন অনুভূত হতে পারে, যা এই শহরের দুর্বল ভবনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ঢাকার সম্প্রসারিত বা নতুন নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে বহুতল ভবন হলে তা মাঝারি মাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। লালমাটির এলাকায় যেসব এক থেকে তিনতলা ভবন নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় ভবনধসে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ভূমিকম্পগবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ১৩টি ভূগর্ভস্থ চ্যুতি রয়েছে। তবে তার সব কটি ঢাকা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হলে ঢাকায় অনেক ভবন ভেঙে পড়তে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প ছাড়াও যে ভবন ভেঙে পড়ে, তার প্রমাণ রানা প্লাজা ধস।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার আরও বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঢাকার ভবনগুলোর বেশির ভাগই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং ভূমিরূপ মেনে নির্মাণ করা হয়নি। এ কারণে তুরস্কে গতকাল হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের চেয়ে কম মাত্রার ভূমিকম্প আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের হিসাবে, ঢাকা শহরে মোট ভবন আছে ২১ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার চেয়ে উঁচু।

রানা প্লাজা ধসের পর বুয়েটের পক্ষ থেকে ঢাকার কোন ভবন কতটা ভূমিকম্পসহনশীল, তা নির্ধারণ করে তালিকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোকে লাল, মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা ভবন হলুদ এবং ভূমিকম্প সহনশীল হলে তা সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বুয়েট সূত্র বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে দেওয়া সেই সুপারিশ মানা হয়নি।

সাভারে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে রেট্রোফিটিং বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ঝুঁকি কমানো হয়। কাজটি করা হয়ে থাকে বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন নিরাপদ করতে আবাসিক ও অন্যান্য ভবনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ঢাকার কিছু ভবনের দেয়ালে ফাটল ও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের আসামে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। ওই সময় ঢাকায় মাত্র ১০০টি পাকা দালান ছিল, অধিবাসী ছিল ৯০ হাজার। ওই ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, ঢাকায় আইন না মেনে এবং নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ বন্ধ করা না হলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এবং সহ–উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩৫ শতাংশ মূলত লাল মাটির ওপরে গড়ে ওঠা। এই মাটি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত। বাকি ৬৫ শতাংশ এলাকা মূলত নদীর তীরবর্তী কাদামাটি ও বালুমাটির এলাকা। মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও পূর্বাচল নতুন শহর এ ধরনের মাটির। বেশির ভাগ বেসরকারি আবাসন প্রকল্প মূলত নরম মাটিতে গড়ে উঠেছে।

গবেষণাটিতে আরও বলা হয়, ঢাকায় ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূকম্পন হলে নরম মাটির ভবনগুলো ভেঙে যাওয়া বা হেলে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অধ্যাপক মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তুরস্কের ভূমিকম্প থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.