বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির চলাচল বাড়ছে, বাংলাদেশ কোথায়

0
215

জ্বালানি তেলে গাড়ি চালানোর দিন কি তবে শেষ হয়ে আসছে? বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রিক ব্যাটারি অর্থাৎ বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির ব্যবহার যে হারে বাড়ছে, তাতে প্রশ্নটির ঝটপট জবাব হচ্ছে, ‘হ্যাঁ।’ কারণ, ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন দেশ তাদের আমদানিকারকদের শুল্ক প্রণোদনা কিংবা শুল্ক ছাড় দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ গাড়ির ব্যবহার খুবই কম। ফলে প্রণোদনাও কম।

তবে সরকার বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার জোরদারে ইতিবাচক বলে জানা গেছে। সে কারণেই গত মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ‘ইলেকট্রিক মোটরযান নিবন্ধন ও চলাচলসংক্রান্ত নীতিমালা’ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারবিডা) সম্প্রতি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে প্রযোজ্য ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কসহ সব ধরনের শুল্ক–কর তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে, যা আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হওয়ার কথা। বাজেটে শুল্ক–কর ধার্যের কাজটি করে মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে জন্য বারবিডা এনবিআরের কাছেই বাজেট–সংক্রান্ত সব দাবিদাওয়া তুলে ধরেছে।

বারবিডা বলেছে, সড়ক ও মহাসড়কে সূর্যের আলো ঢেকে দেয় যে কালো ধোঁয়া, তা থেকে কার্বনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান নির্গত হয়ে বাতাসে দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রবহমান থাকে। বায়ুর মান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী দেশে এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ১০ থেকে ১২ মাইক্রোগ্রাম। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ পরিবেশ সুরক্ষায় সক্রিয় এমন সব দেশে এর পরিমাণ শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম।

অর্থাৎ বাংলাদেশের বায়ুতে বিপজ্জনক কালো কার্বনের উপস্থিতি ১০০ থেকে ১২০ গুণ বেশি। এ অবস্থা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে দূষণমুক্ত মোটরযান আমদানি উৎসাহিত করতে শুল্ক–করকাঠামো ঢেলে সাজানো উচিত এনবিআরের।

বারবিডা বলেছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মোটরযানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমে আসবে। সংগত কারণেই তখন বাংলাদেশেও বৈদ্যুতিক গাড়ির গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়বে।

জানতে চাইলে বারভিডার সভাপতি হাবিবউল্লাহ ডন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বেই দূষণে এগিয়ে থাকা শহরগুলোর মধ্যে দিল্লি ও ঢাকার নাম প্রথম সারিতে রয়েছে। এ থেকে রক্ষা পেতে পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার শুরু করা জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে ২০৩৫ সালের পর জ্বালানি তেলচালিত গাড়ি আর চলবে না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনে মনোযাগ দিয়েছে।

যেমন চীনে এই মুহূর্তে ৫০টি কারখানা রয়েছে। ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়লে জ্বালানি তেল আমদানিতে এত ডলার খরচ করতে হবে না।
বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিলে দেশে এটির ব্যবহার বাড়বে বলে মনে করেন হাবিবউল্লাহ ডন। এ জন্য প্রধান শহরগুলোতে চার্জিং পয়েন্ট বা চার্জিং স্টেশন তৈরির ব্যবস্থা করা দরকার বলে পরামর্শ দেন তিনি।

স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে ২০ লাখ ইউনিট। আর ২০২৩ সালের জন্য ৭১ লাখ ও ২০২৭ সালের জন্য তা ১ কোটি ৬২ লাখ ইউনিট প্রাক্কালন করা হয়েছে।

কেন ইলেকট্রিক গাড়ি

বারবিডা বলেছে, বিশ্বব্যাপী ফসিল ফুয়েল তথা জীবাশ্ম জ্বালানিবিহীন মোটরযানের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশকেও ব্যাপকভাবে এ ধরনের গাড়ি ব্যবহারের পথে যেতে হবে। কারণ, বৈদ্যুতিক গাড়ি জ্বালানি–সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তাই বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে সম্পূর্ণ শুল্ক ছাড় জরুরি।

এ ছাড়া রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের বিবেচনা। জ্বালানি তেলের চেয়ে ইলেকট্রিক গাড়িতে চার গুণ বেশি জ্বালানি সাশ্রয় হবে। পরিবহন খাতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমলে তখন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে তেল আমদানি কমবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চাপ রয়েছে, তা কমবে।

সংগঠনটির আবেদনে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, টয়োটা বিজেডফোরএক্স বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির সক্ষমতা ৭২ দশমিক ৮ কিলোওয়াট। এটি পূর্ণ চার্জ হতে সময় লাগবে ৯ দশমিক ৩ ঘণ্টা। এ চার্জে ৫১০ কিলোমিটার পথ অনায়াসে পাড়ি দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৩০টি ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য সংস্থাটি থেকে নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও অনেকে।

আমদানির পাশাপাশি দেশেও বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের কারখানা তৈরি হচ্ছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে গড়ে তোলা হচ্ছে এই কারখানা। এ জন্য ১০০ একর জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তারা ২০১৮ সাল থেকে কারখানা তৈরির কাজও শুরু করেছে। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিটি বৈদ্যুতিক গাড়ি ৭ থেকে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি করবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

২০২০ সালে ভারতের টাটা নিক্সেন সেই দেশে প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে আসে। আগের মডেলের মতোই নতুন টাটা নিক্সন ইভিটিও ৩০.২ কেডব্লিউএইচ ভার্সন বাজারে আনা হয়। এ ধরনের গাড়িতে এমনই একটি বড় ব্যাটারি প্যাক দেওয়া হচ্ছে, যাতে একবার চার্জেই ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চালানো যাবে গাড়ি।

কোন দেশ কী সুবিধা দিচ্ছে

বারবিডা এনবিআরকে জানিয়েছে, বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) ১২ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং গাড়ির চার্জার ও চার্জিং স্টেশনের জন্য জিএসটি ১৮ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে ভারত। এমনকি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পরিবেশবান্ধব ব্যাংকিংয়ের আওতায় বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার জন্য স্বল্প সুদে অর্থ সহায়তা করছে।

অস্ট্রেলিয়ায় বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর স্ট্যাম্প শুল্কসহ অন্যান্য কর রেয়াত রয়েছে ৫০ শতাংশ। নিউজিল্যান্ড এ ধরনের নতুন গাড়ির ওপর ৮ হাজার ৬২৫ নিউজিল্যান্ড ডলার (বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ টাকা) এবং ব্যবহৃত গাড়িতে ৩ হাজার ৪৫০ নিউজিল্যান্ড ডলার পর্যন্ত নগদ ভর্তুকি দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনায় প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে সাত হাজার ডলার পর্যন্ত। আর যুক্তরাজ্য সড়ক করে (রোড ট্যাক্স) ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনায় আড়াই হাজার পাউন্ড পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে।

চীনও নগদ ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে এই গাড়ি কেনায় উৎসাহ দিচ্ছে। সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী দেশটি সব ধরনের বৈদ্যুতিক যানবাহন ক্রয়ের বিপরীতে কর নেওয়া বাদ দিয়েছে। মালয়েশিয়া আমদানি ও আবগারি শুল্কের পাশাপাশি বিক্রয় করও প্রত্যাহার করেছে।

সিঙ্গাপুরে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিবন্ধন করলেই নিবন্ধন মাশুল ৪৫ শতাংশ মওকুফ। এ ছাড়া ট্যাক্সিক্যাবের ক্ষেত্রে নিবন্ধন মাশুল ৪৫ মার্কিন ডলার ছাড় রয়েছে দেশটিতে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে বারবিডার যুক্তি থাকতে পারে, তবে শুল্ক না দিলে সরকার রাস্তা তৈরি করবে কীভাবে? আর রাস্তা তৈরি না হলে গাড়ি চলবে কোথায়? আমার মতে, কমবেশি যাই হোক না কেন বড় লোকেরা শুল্ক দিয়েই গাড়ি কিনুক।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.