পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়ছে, দুশ্চিন্তা সুতার বাড়তি দামে

রপ্তানি খাত

0
111
পোশাক শিল্প

করোনা মহামারির শুরুতে সাভারে এনআর ক্রিয়েশন নামের একটি নিট পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন আলকাছ মিয়া। শুরু থেকেই সরাসরি ক্রেতার ক্রয়াদেশ নিয়ে কাজ করছে তাঁর ছোট্ট কারখানাটি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্তও পোশাকের পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ আছে তাদের হাতে। কিন্তু হঠাৎ সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় সাড়ে চার লাখ পিস পোশাক রপ্তানি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

এনআর ক্রিয়েশনের স্বত্বাধিকারী আলকাছ মিয়া গত মঙ্গলবার বলেন, ‘ফ্রান্সের এক ক্রেতার এক লাখ পলো শার্টের ক্রয়াদেশ আছে। ওই ক্রয়াদেশে প্রতি কেজি সুতার দাম ধরা ছিল ৩ ডলার। এখন তা বেড়ে সাড়ে ৩ ডলার হয়ে গেছে। সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় মুশকিলে পড়ে গেছি। এখন যদি ক্রেতা দাম বাড়ায়, তাহলে কাজটি করতে পারব, না হলে বাতিল করতে হবে।’ সাড়ে ৩ লাখ পিসের আরেকটি ক্রয়াদেশ নিয়েও একই সমস্যায় আছেন বলে জানান তিনি

গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশে খরার কথা বলছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরাই এখন বলছেন, দুই মাস ধরে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ আসছে। এতে আগামী মাস (অক্টোবর) থেকে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোতে কাজের চাপ বাড়বে। তবে একই সময়ে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ নিয়ে বড় ঝামেলার আশঙ্কাও করছেন উদ্যোক্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিট পোশাক তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত ৩০ সিঙ্গেল কার্ড সুতার কেজি গত জুলাইয়ের শুরুতে ছিল ২ ডলার ৯০ সেন্ট। বর্তমানে সেই সুতা সাড়ে ৩ ডলার বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। একই সময়ে ওভেন পোশাক তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত ৩০ সিঙ্গেল কমড সুতার কেজি দাম ৩ ডলার ২ সেন্ট থেকে বেড়ে এখন ৩ ডলার ৮৫ সেন্ট হয়েছে। অন্যান্য সুতার দামও বেড়েছে।

ছয় মাস ধরে স্পিনিং মিলগুলো লোকসান করছে। এখন সামান্য দাম বাড়ার পরও প্রতি কেজিতে লোকসান দিতে হয় ২০-২৫ সেন্ট।মোহাম্মদ আলী, সভাপতি, বিটিএমএ

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘সাধারণত এক থেকে দেড় মাস আগে বিদেশি ক্রেতাদের পোশাক তৈরির কস্টিং শিট দিয়েছে কারখানাগুলো। এখন চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ আসছে। এই সময়ের মধ্যে সুতার দাম বেড়ে গেলে আমরা তো ক্রেতাদের কাছে বাড়তি দাম চাইতে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ নিয়ে সব কারখানাই সমস্যায় পড়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, দেশ থেকে গত ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি তার আগের বছরের তুলনায় দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ।

পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়ছে
দেশের শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ঢাকার রাইজিং গ্রুপ। তাদের ছয়টি কারখানা থেকে বছরে ১৫-১৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এই গ্রুপের কারখানাগুলোতে পোশাকের ক্রয়াদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে।

রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বলেন, গত জুলাই, আগস্ট ও চলতি সেপ্টেম্বরের তুলনায় আগামী মাসের ক্রয়াদেশ ১০-১৫ শতাংশ বেশি। আগামী গ্রীষ্মের পোশাকের ক্রয়াদেশ গতবারের চেয়ে কিছুটা ভালো। এর কারণ ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির চাপ খানিকটা কমেছে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রে পণ্যের মজুত হ্রাস পেয়েছে। ফলে মানুষ সচরাচর পরিধান করে এমন সব মৌলিক পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়ছে।

পোশাক খাতের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপ। তাদের কারখানাগুলোতেও ক্রয়াদেশের চাপ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের পোশাকের ক্রয়াদেশ গতবারের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। তাতে অক্টোবর থেকে কাজের চাপ বাড়বে।

বিশ্ববাজারে তুলার দাম বাড়েনি। ফলে এখন সুতার মূল্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। স্পিনিং মিলগুলোর বাড়তি দাম নেওয়ার প্রবণতা দ্রুত বন্ধ না হলে বিদেশি সুতার আমদানি বাড়বে।ফারুক হাসান, সভাপতি, বিজিএমইএ

ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক শাহ রাইদ চৌধুরী বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করাতে পারছি না। আশা করছি, সামনের মাস থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করানো যাবে।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার ও চীন থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হচ্ছে।’

শুধু পোশাক নয়, বস্ত্রকলেও ক্রয়াদেশ আসছে। যেমন শাশা ডেনিম আগামী নভেম্বর পর্যন্ত পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালানোর মতো ক্রয়াদেশ ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। গত বছরের তুলনায় তাদের ক্রয়াদেশ কমপক্ষে ৫ শতাংশ বেশি।

শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, আগামী জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। সে জন্য নিয়মিত অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগেভাগে ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। আবার গত বছরের ক্রিসমাসে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মজুত পণ্যই বেশি বিক্রি করেছে। ইতিমধ্যে সেই মজুত অনেকটাই শেষ হয়েছে। ফলে গতবারের চেয়ে ক্রয়াদেশ আসা বেড়েছে।

সুতার দাম নিয়ে জটিলতা
তৈরি পোশাকের প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে, এমন সময়ে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কেমন সমস্যা হচ্ছে—এই প্রশ্ন করলে নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম নিজের কারখানার উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান ১৬ লাখ ডলারের একটি ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এই ক্রয়াদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পিসি সুতা এক মাস আগে একটি স্পিনিং মিল দাম চেয়েছিল প্রতি কেজি ২ ডলার ৩০ সেন্ট। এখন ক্রয়াদেশ চূড়ান্ত হওয়ার পর দাম চাইছে ২ ডলার ৭৫ সেন্ট। এতে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ২২ লাখ টাকা। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে পিসপ্রতি ৮ সেন্ট চেয়েছি। তারা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এভাবে বিপুল লোকসান দিয়ে ওই ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়।’

কয়েকজন তৈরি পোশাকশিল্প মালিক দাবি করেন, পোশাকের ক্রয়াদেশ আসতে থাকায় হঠাৎ সুতার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়িয়ে দিয়েছে স্পিনিং মিলগুলো।

পোশাকশিল্প মালিকদের এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে আমরা একটি স্পিনিং মিলের উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, হঠাৎ সুতার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। যদিও রপ্তানিমুখী পোশাকের সুতার দাম বাড়লেও স্থানীয় বাজারের জন্য তৈরি করা পোশাকে ব্যবহৃত সুতার দাম কিন্তু বাড়েনি।

অবশ্য সুতার দাম নিয়ে এবারই প্রথম হইচই হচ্ছে, তা নয়। দুই বছর আগে ৩০ সিঙ্গেল কার্ডের প্রতি কেজি সুতা ৪ ডলার ২৫ সেন্ট থেকে ৪ ডলার ৪০ সেন্টে বিক্রি হয়েছিল। তখন হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলোর মালিকেরা। কয়েক দফা বৈঠকের পর বিষয়টির সুরাহা হয়।

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘গত তিন মাসে সুতার দাম মাত্র ৩০ সেন্ট বেড়েছে। ছয় মাস ধরে স্পিনিং মিলগুলো লোকসান করছে। এখন সামান্য দাম বাড়ার পরও প্রতি কেজিতে লোকসান দিতে হয় ২০-২৫ সেন্ট। প্রতি কেজি সুতা তৈরিতে ৩ ডলারের তুলাই লাগে। ৩৭ সেন্টের গ্যাস লাগে। তারপর তো অপচয়, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় আছে। তারপরও আমরা স্পিনিং মিলগুলোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বসেছি। তাঁদের বাজার স্থিতিশীল করতে সুতার দাম সহনীয় রাখতে বলেছি।’

অন্যদিকে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, দেশীয় সুতা ব্যবহার করলে ৪ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। তাই আমদানি করা সুতার সঙ্গে দেশীয় স্পিনিং মিলের সুতার দামের তফাত প্রতি কেজিতে ১৫-২০ সেন্ট হলেও পোশাক কারখানাগুলো তা নিয়ে থাকে। হঠাৎ এই দামের পার্থক্য বর্তমানে ৫০-৭০ সেন্ট, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ সেন্টেও পৌঁছেছে। বিশ্ববাজারে তুলার দাম বাড়েনি। ফলে এখন সুতার মূল্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। স্পিনিং মিলগুলোর বাড়তি দাম নেওয়ার প্রবণতা দ্রুত বন্ধ না হলে বিদেশি সুতার আমদানি বাড়বে।

শুভংকর কর্মকার

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.