রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সমাজের বাতিঘর, অর্জিত জ্ঞানের গুদামঘর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবসময় আলো ছড়ায়, মানবিকতার বিকাশ ঘটায় এবং সমাজকে আলোর পথ দেখায়। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা থেকে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের আবির্ভাব ঘটে। নেতৃত্বে বিকাশ ঘটে। আজ থেকে কিশোরগঞ্জের সেই বাতিঘরের যাত্রা শুরু হলো। একে লালন করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
শুক্রবার বিকেলে কিশোরগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের প্রায় সকল জেলায়ই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে বা হচ্ছে। কিন্তু সবগুলোর মান সমান নয়। আমরা চাই এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই গুণেমানে সমৃদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হোক। যুগের চাহিদা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম নির্ধারণ করতে হবে। বিভাগ খোলার ক্ষেত্রেও বাস্তবতা ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে। দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিভাগ রয়েছে, যেখানে লেখাপড়া করলে হয়তো জ্ঞানার্জন সম্ভব হবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ একেবারেই সীমিত।
রাষ্ট্রপতি বলেন, শিক্ষার্থীরাও বুঝে না বুঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ভাব ধরার জন্য এসব বিভাগে ভর্তি হন। মা-বাবা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক কষ্টে লেখাপড়ার খরচ যোগান। কিন্তু পাশ করার পর সেই গানের কলি হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ এর মত হান্ড্রেড পার্সেন্ট বেকারে পরিণত হন। অনেকে মা-বাবার আশা মিটাতে না পেরে বিপথে পরিচালিত হন। অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের চেয়ে শিক্ষিত বেকারের বোঝা পরিবার ও সমাজের জন্য অনেক বেশি কষ্টের।
তিনি বলেন, আমার নিজের রাজনীতির চারণভূমিতে জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ’ এর শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে আমি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানটি আমার নিজের এবং কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য ভিন্ন মাত্রার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জবাসীর অনেক দিনের বহু কাঙ্ক্ষিত একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলো।
রাষ্ট্রপতি পাঠদান ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, আজকাল মা-বাবাসহ সবাই চান ছেলেমেয়েরা জিপিএ/গোল্ডেন জিপিএ পাক বা ফার্স্ট/সেকেন্ড হোক। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না ছেলেমেয়েরা কতটুকু শিখল বা জানল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভাল ফল করে প্রতিষ্ঠানের নাম বাড়ানোর লক্ষ্যে সহজপাঠ্য ও চমকপ্রদ উপায়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কষ্ট করে টেক্সট বই না পড়ে শিক্ষকের দেয়া নোট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ভাল নম্বর ওঠান। কষ্ট না করেই কেষ্ট অর্জন। এরিস্টটলের ভাষায় ‘শিক্ষার শেকড় তেতো হলেও ফল মিষ্টি’। তাই আশা করবো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবেন, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষিত করে তুলতে পারেন।
তিনি বলেন, অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজের ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে। আমি আর এক মাস ২২ দিন রাষ্ট্রপতি আছি। রাষ্ট্রপতি না থাকলেও নিজস্ব ক্যাম্পাসে কত অল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তর করা যায়, সেই চেষ্টা আমি সবসময় করে যাব।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতার কারণে শহর ও মফস্বল এলাকার মধ্যে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যোগ্যতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আমাদের এলাকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে লেখাপড়ার পরিবেশ ও মানোন্নয়নের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস। যার অসামান্য ত্যাগ আর নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক। আমি সেই নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তিনি জাতীয় চার নেতাসহ ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জেড এম পারভেজ সাজ্জাদের সভাপতিত্বে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য নেহাল আহমেদের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য প্রদান করেন, সিন্ডিকেট সদস্য কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, সিন্ডিকেট সদস্য কিশোরগঞ্জ-১ আসনের এমপি ডা. জাকিয়া নূর লিপি, সিন্ডিকেট সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সামাদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ইমান আলী ও গুরুদয়াল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আ.ন.ম মুশতাকুর রহমান।বক্তৃতাশেষে রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপাচার্য অধ্যাপক জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ একটি স্মারক ক্রেস্ট উপহার দেন। রাষ্ট্রপতিও উপচার্যকে বঙ্গভবনের পক্ষ থেকে একটি ক্রেস্ট উপহার দেন। রাষ্ট্রপতি বিকাল ৪টা ৪৭ মিনিটে মঞ্চ ত্যাগ করেন এবং হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় রওনা হন।
বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০২১ সালে। সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নে ১০৩ একর জায়গার ওপর সকল অবকাঠামো নির্মিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভিডিও চিত্রে এর দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোগত স্থাপত্যশৈলি প্রদর্শন করা হয়। বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ দফার প্রতিকী বেদীর ওপর থাকবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিশোরগঞ্জের তিনজন রাষ্ট্রপতির নামে শিক্ষার্থীদের তিনটি ১৮ তলা হল নির্মিত হবে। একটি হবে মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে। একটি হবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের নামে। একটি হবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নামে।
বর্তমানে চারটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালটি গুরুদয়াল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পসে চালু হচ্ছে। এগুলো হলো-গণিত, ইংরেজি, হিসাব বিজ্ঞান ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রথম ব্যাচে শিক্ষার্থীও ভর্তি করা হয়েছে ৩০ জন করে। এরা মূলত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।