টুর্নামেন্ট শুরুর ১১তম দিনে প্রথম ‘অঘটন’ দেখল বিশ্বকাপ। আজ দিল্লিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ৬৯ রানে হারিয়েছে আফগানিস্তান। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটি আফগানদের দ্বিতীয় জয়।
প্রথমে ব্যাট করে ২৮৪ রান তুলেছিল আফগানিস্তান। রান তাড়ায় ২১৫ রানে থেমে যায় ইংল্যান্ডের ইনিংস।
ইংল্যান্ডকে হারাতে কী দরকার? উত্তরটা নিশ্চয়ই সহজ নয়। সাদা বলের ক্রিকেটের রাজা তো তাঁরাই। ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ — সবই তো তাদের দখলে। এমন দলকে হারাতে হলে ভাগ্য তো বটেই, আরও অনেক কিছুই পক্ষে থাকতে হয়। এই যেমন উইকেট হতে হবে এমন, যেখানে বল একটু থেমে আসবে। বাউন্স থাকবে অসমান। শট খেলার আগে ব্যাটসম্যান থাকবেন দোটানায়। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানে ঠাসা ইংলিশ ব্যাটিংকে থামানোর জন্য এমন উইকেটই তো চাই।
দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামের উইকেট আজ ঠিক তেমন আচরণই করছিল। সেই সুবিধাটা কাজে লাগিয়েই ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে কোন উইকেট না হারিয়ে ৭৯ রান করার পরও আফগানিস্তানকে ২৮৪ রানে থামাতে পেরেছে ইংল্যান্ড। আদিল রশিদ তো আছেনই। সঙ্গে জো রুট ও লিয়াম লিভিংস্টোনের মতো অনিয়মিত স্পিনারদেরও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। যে উইকেটে রুট-লিভিংস্টোনদের স্পিন ধরছিল, সেখানে রশিদ খান-মুজিব উর রেহমানরা কেমন করবেন, তা আঁচ করাই যায়। সে অনুমানই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। স্পিন দিয়েই ইংল্যান্ডকে ৪০.৩ ওভারে ২১৫ রানে অলআউট করেছে আফগানরা। ইংল্যান্ডের ১০ উইকেটের ৮টিই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন মুজিব, রশিদ ও মোহাম্মদ নবী। এর আগে ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডকে হারিয়েছিল আফগানিস্তান।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে কিছু ব্যাপার প্রত্যাশিত। জনি বেয়ারস্টো পাওয়ার প্লেতে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করবেন। ডেভিড ম্যালান একটু দেখেশুনে খেললেও স্ট্রাইক রেটে তিনি পিছিয়ে থাকবেন না। এই দুই ওপেনারকে থামানোর উপায় একটাই— উইকেট নেওয়া। দুজনই বাউন্ডারির খোঁজ করবেন, সেই ভয়ে আক্রমণাত্মক বোলিং থেকে সরে এলে চলবে না। উইকেট নেওয়ার ভাবনা থেকেই বোলিং করতে হবে। আজ ফজলহক ফারুকি ঠিক তাই করলেন। নতুন বলে যতটুকু সুইং ছিল তা কাজে লাগিয়েছেন। বেয়ারস্টো আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠার আগেই এলবিডব্লু। ৪ বল খেলে ২ রান করেই আউট হন ইংলিশ ওপেনার।
তাতে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ক্রিজে নামতে হয় জো রুটকে। আগের দুই ম্যাচে ৭৭ ও ৮২ রানের ইনিংস খেলা রুটই দিল্লির মন্থর উইকেটে আফগান স্পিন সামলানোর সামর্থ্য রাখেন। এই ম্যাচ জিততে হলে রুটকে বড় ইনিংস খেলতেই হতো। কিন্তু ইংলিশদের দুর্ভাগ্য, সপ্তম ওভারে মুজিবের গুগলি বল গুড লেংথ থেকে এতটাই নিচু হয়ে স্টাম্পে আসে যে, রুট (১১) চেষ্টা করেও ব্যাট নামাতে পারেননি।
বাঁহাতি ম্যালানের জন্য আরেক অফ স্পিনার মোহাম্মদ নবী তো আছেনই। ১৩তম ওভারে নবীর গতির বৈচিত্র্যের ফাঁদে পড়ে কাভারে আলগা শট খেলে বসেন গত ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা ম্যালান। সেখানে ইব্রাহিম জাদরান সহজ ক্যাচ লুফে নিলে ৩২ রানে থামে ম্যালানের ইনিংস। হ্যারি ব্রুকের সঙ্গে ম্যালানের ৩৫ রানের জুটিও ভাঙে তাতে। এরপর ইংলিশ ইনিংসে আর কোনো জুটি ৩০ ছাড়ায়নি।
ম্যালান যখন আউট হন, তখন ইংল্যান্ডের রান ১২.৪ ওভারে ৩ উইকেটে ৬৮। আফগানদের সেরা বোলার রশিদ খান তখনো বোলিং শুরু করেননি। তাঁর ১০ ওভার যে খুব হিসেব করে ব্যবহার করা হবে, তা তো অনুমেয়ই। মাঝের ওভারে এক প্রান্ত থেকে পেসারদের দিয়েও চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবেন হাশমতউল্লাহ শহীদির দল। সেই পেসার আর কেউ নন, নাভিন উল হক। দিল্লির উইকেটের অসম বাউন্সের সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে ১৮তম ওভারে ইংলিশ অধিনায়ক জস বাটলারকে (৯) বোল্ড করেন তিনি।
লিভিংস্টোন, স্যাম কারেন, ক্রিস ওকস, একে একে ড্রেসিংরুমে ফিরে যান ইংল্যান্ডের তিন অলরাউন্ডার। মাঝের ওভারে এঁদের নিয়েই যিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই ব্রুকও ফিফটি করে মুজিবের বলে আউট হন। তার আগে ৬১ বলে ৬৬ রানের দারুণ ইনিংস খেলেন তিনি। আদিল রশিদ, মার্ক উড ও রিচ টপলিরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। স্পিনে ধরাশায়ী হয়ে ৪০.৩ ওভারে ২১৫ রানে শেষ ইংলিশ ইনিংস।
মেরে খেলার ব্যাটসম্যান আছে। কিন্তু ধরে খেলার নেই। ৫০ ওভারের খেলায় আফগানিস্তান দলের ব্যাটিং নিয়ে এই অভিযোগটা পুরোনো। এবং অনেকটা সত্যিও বটে। এশিয়া কাপ থেকেই আফগানিস্তানের ব্যাটিং মানেই রহমানউল্লাহ গুরবাজ না হয় ইব্রাহিম জাদরান। এই দুই ওপেনার দ্রুত আউট হলে আফগানিস্তানের ৫০ ওভার খেলাও কঠিন হয়ে পড়ে। আজ হলো উল্টোটা। গুরবাজ ও ইব্রাহিমের উদ্বোধনী জুটি থেকেই আসে ১১৪ রান, সেটাও বেশ দ্রুত (১৬.৪ ওভারে)। আফগানিস্তানও বড় রান করার মঞ্চটা পেয়ে যায় তাতে।
কিন্তু টপ অর্ডার থেকে কাঙ্ক্ষিত রান এসেছে ইংলিশ পেসারদের কারণে। দিল্লির এই মাঠের কন্ডিশন আজ পেসারদের কাজটা শুরু থেকেই কঠিন করে তুলছিল। বল ব্যাটে আসছিল স্বাচ্ছন্দ্যে, দারুণ বাউন্স। গুরবাজের মতো বিস্ফোরক ব্যাটসম্যানের জন্য যা আদর্শ। তরুণ এই আফগান ওপেনার ওকস-টপলিদের ওপর শুরু থেকেই চড়াও হন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে। কারেন-উডও বাদ যাননি। যে-ই বোলিংয়ে এসেছেন, মার খেয়েছেন।
অন্য দিকে ইব্রাহিম পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করে যাওয়ার লক্ষ্যে খেলছিলেন। তাতে স্ট্রাইক রেটটা দৃষ্টিকটু মনে হলেও আফগানিস্তানের দলের এটাই দরকার ছিল। কিন্তু মাঝের ওভারে স্পিনারদের বোলিংয়ে আনার পর ইংলিশদের চোখ খুলে যায়। বল গ্রিপ করছে, হচ্ছে টার্ন। যার সুবিধা কাজে লাগিয়ে আদিল রশিদ নিজের করা তৃতীয় ওভারেই ইব্রাহিমকে আউট করেন। ৪৮ বল খেলে ২৮ রান করে জো রুটের হাতে ক্যাচ তোলেন তিনি।
১৯তম ওভারে এসে তিনে নামা রহমত শাহকে আউট করেন আদিল। আফগানদের দুর্ভাগ্য, ঠিক পরের বলেই রান আউট গুরবাজ! ৫৭ বল খেলে ৮০ রান করা আফগান ওপেনারের ইনিংস থামে বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নামা ডেভিড উইলির থ্রোতে। ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় সাজানো দুর্দান্ত ইনিংসটি থামে তাতে। আফগানদের রান তখন ১২২। মাঝের ওভারে অনেকটা পথ তখনো বাকি। যা পাড়ি দিতে হলে একজনের টিকে থাকতে হতো।
দলের বিপদে বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা ইকরাম আলীখিল হয়ে উঠলেন সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাটসম্যান, যাকে ঘিরে আফগানিস্তানের মারকুটে ব্যাটসম্যানরা হাত খুলে খেলবেন। আর ইকরাম আরেক প্রান্ত আগলে রাখবেন। হয়েছেও তাই। ইকরাম ৪৮তম ওভার পর্যন্ত টিকে ছিলেন। ৬৬ বল খেলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় তিনি ৫৮ রান করেন। আর রশিদ-মুজিবরা অন্য প্রান্ত থেকে ছোট ছোট ইনিংস খেলে আফগানদের নিয়ে যান ২৮৪ রানে। আফগানদের ১০ উইকেটের ৫টিই নিয়েছেন ইংলিশ স্পিনাররা। রশিদ, লিভিংস্টোন ও রুটের ২৪ ওভার থেকে রান উঠেছে মাত্র ৯৪।
তবে শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্পিন-শ্রেষ্ঠত্বই তুলে ধরেছে আফগানরা। যা তাদের এনে দিয়েছে এবারের আসরে প্রথম আর বিশ্বকাপে দ্বিতীয় জয়।