বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তিতে তোড়জোড়

0
110
মামলা নিষ্পত্তি

বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা মামলা নিষ্পত্তি গতি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মামলার রায় হয়েছে। অনেক মামলার অগ্রগতি লক্ষণীয়। আবার অনেক মামলা দ্রুত শেষ করার নির্দেশনাও গেছে আদালতে। জাতীয় নির্বাচনের আগে শম্বুকগতির মামলার হঠাৎ গতি পাওয়াকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ‘রাজনৈতিক চাল’ হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা আর আন্দোলন দমনই এর পেছনের উদ্দেশ্য। যদিও আদালত-সংশ্লিষ্টরা একে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবেই দেখছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। শ্রম আদালতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের মামলা নিম্ন আদালতে চলবে বলে সম্প্রতি রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে করা মামলার বিচার নিম্ন আদালতে চলবে বলে আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

দশ বছর আগে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীকে সরিয়ে দেওয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্রসহ দু’জনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নাল আবেদীন বলেন, সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক মামলায় বেআইনি রায় দিচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এসব মামলার রায় ও সাজা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন, মামলার সিরিয়াল মেইনটেইন না করে, যেসব মামলা রাজনৈতিক সেগুলোকে সামনে এনে দ্রুত সাজা দিচ্ছে। সাজার মাধ্যমে অতীতের মতো বিরোধী দলকে দমনের চেষ্টা করছে সরকার।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, জনস্বার্থের মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন। কারণ, এসব মামলা সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল এবং সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই। দেশের রিজার্ভ চুরিসংক্রান্ত মামলার তদন্ত দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে হওয়া শতাধিক মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে যেসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মনিটরিং কমিটিকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি এবং স্থগিত মামলা সচলেরও নির্দেশনা দেওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের।

বিএনপির নেতাকর্মীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত ও দ্রুত সাজা দিতে সরকার ‘পিক অ্যান্ড চুজ তত্ত্ব’ গ্রহণ করেছে। তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য এ প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ২০০৭ সালের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ২ আগস্ট তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে যথাক্রমে ছয় বছর ও তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার জজ আদালত। চার্জ গঠনের মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যেই মামলার রায় হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা দুটি দুর্নীতির মামলায় বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমান উল্লাহ আমানকে বিচারিক আদালতের দেওয়া কারাদণ্ড গত ৩০ মে বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায় গত ১৭ আগস্ট শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানসহ পাঁচজনকে ২ ধারায় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের বেশ কয়েকটি মামলা দীর্ঘদিন ধরে আদালতে বিচারাধীন।

এরই মধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ২২ আগস্ট শুরু হয়েছে। ২০২১ সালের করা মামলায় গত ৬ জুন অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। এ মামলাটিতেও দ্রুত সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিযোগ করেন তাঁর আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন।

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারাধীন মামলাগুলো ধারাবাহিকভাবে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য আদালত গ্রহণ করে থাকেন। এখানে রাজনৈতিক বিষয় নয়, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এগুলো করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কারও নির্দেশে বা আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয়ে মামলা পরিচালনা করে না। তিনি বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ১৪ বছর পর নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। আইন ও বিধি অনুযায়ী আমরা মামলা পরিচালনা করে থাকি।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের করা রিজার্ভ চুরির মামলাটি তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। ওই দিন আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে না পারায় গত ৩১ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০ সেপ্টেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করেন। এ নিয়ে ৭৩তম বারের মতো প্রতিবেদন দাখিল পেছাল। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ৫৯টি মামলাও সাত বছর ধরে ঝুলে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার হয়। অর্থ আত্মসাতের মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং ১৪৬ ব্যাংকারের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ হবে কিনা– তার জন্য ৭ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য রয়েছে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ শততম বারের মতো পিছিয়েছে। র‍্যাবের তদন্ত শেষ না হওয়ায় ঢাকার আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।

বিআইডিএসের অর্থনীতিবিদ সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলাটি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই মেয়েকে নিতে রিকশায় করে রাজধানীর বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুলে যাচ্ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী সগিরা। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ডের জন্য মামলাটি এখন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় বলে প্রসিকিউশন যে মামলাগুলো এগোতে চায়, সেসব মামলাই গ্রহণ করেন আদালত।

আলোচিত হত্যা, ধর্ষণ, জঙ্গি হামলাসহ অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতিসহ বেশ কিছু জনস্বার্থ মামলার রিট আবেদন এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসসংক্রান্ত হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত আদেশও ১০ বছর ধরে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

২০১৩ সালে দুর্ঘটনার পর রানা প্লাজা ধসসহ বেশ কয়েকটি কারখানা বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে চারটি সংস্থার রিট দাখিল করা হয়েছিল। চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত তা দাখিল করা হয়নি। আবেদনের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সচিবরা আদালতে প্রতিবেদন জমা দেননি বা এখনও কোনো জবাব দেননি।

মানবাধিকার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, রাষ্ট্র যেহেতু সব ফৌজদারি মামলার বাদী, তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলাগুলো শুনানির জন্য নির্বাচন করে। কখনও কখনও আইনজীবীরা বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত করেন, কারণ আদালত সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি করতে আগ্রহী কম। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রুলের শুনানির জন্য ১১ বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.