বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাড়িতে কারা থাকছেন

0
59
বাড়িটি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসভবন

গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী কামাল হোসেন। থাকেন রাজধানীর মিন্টো রোডের ২৯ নম্বর বাড়ির পেছনে থাকা আধপাকা টিনশেড ঘরে।

বাড়িটি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসভবন। তবে দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ বাড়িতে বিরোধীদলীয় কোনো নেতা ওঠেননি।

মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের স্থায়ী বাসিন্দা কামালের বয়স এখন ৫০ বছর। তিনি তাঁর চাকরিজীবনের ১৭ বছর পরিবার নিয়ে এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন।

বিশাল আয়তনের বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা কামালের কাজ। তিনি বলেন, তাঁর একটা অপ্রাপ্তি আছে। তা হলো, যাঁর জন্য বাড়িটি নির্ধারিত, এখন পর্যন্ত এমন কাউকে তিনি এখানে থাকতে দেখেননি। ফলে বাড়িটি অভিভাবকশূন্য রয়েছে। চাকরির বাকি সময়ে কোনো বিরোধীদলীয় নেতাকে এই বাড়িতে থাকতে দেখে যেতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবেন তিনি।

বাড়িটির ভেতরের আধপাকা টিনশেড ঘরে সপরিবার থাকেন লাল মিয়া নামের আরেকজন। তাঁর বয়স ৫৫ বছর। তিনি পেশায় মালি। এখানে তিনি ৮ বছর ধরে আছেন।

লাল মিয়া বলেন, যাঁর জন্য বাড়িটি নির্ধারিত, তিনি থাকলে বাড়িটি প্রাণবন্ত ও সরগরম থাকত। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের যাতায়াত থাকত।

সরেজমিন দেখা যায়, বিরোধীদলীয় নেতা না থাকলেও বাড়িটির ভেতরের আধপাকা টিনশেড ঘরে অন্তত ৩০ জন বসবাস করছেন। তাঁরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করেন।

বাড়িটির পেছনের অংশে বেশ কয়েকটি আধপাকা টিনশেড ঘর আছে

ঢাকার অন্যতম নিরাপদ এলাকা মিন্টো রোড। মন্ত্রিপাড়া বলেও পরিচিত এটি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ব্রিটিশ আমলে আড়াই একর জায়গার ওপর বাড়িটি (২৯ নম্বর বাড়ি) করা হয় তখনকার সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একসময় বাড়িটি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারণ করা হয়। বাড়িতে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উঠেছিলেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত তাঁর নামে বাড়িটি বরাদ্দ ছিল। এরপর আর কোনো বিরোধীদলীয় নেতা এ বাড়িতে ওঠেননি।

লাল-সাদা রঙের দোতলা বাড়িটি এখন অনেকটাই শ্রীহীন। বিরোধীদলীয় নেতা থাকেন না বলে গণপূর্ত অধিদপ্তরও বাড়িটি সংস্কার করছে না।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদক মিন্টো রোডের ২৯ নম্বর বাড়িটি দেখতে যান। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয় থেকে অল্প দূরত্বে রাস্তার ওপর থেকে বাড়িটি চোখে পড়ে।

বাড়িটির আশপাশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, ডিএমপি কমিশনার, একজন বিচারপতি, একজন নির্বাচন কমিশনার, পররাষ্ট্রসচিব, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, ঢাকা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বাসভবন রয়েছে।

বাড়িটির মূল ফটক খোলা পাওয়া গেল। ফটকে ছিলেন না কোনো নিরাপত্তাকর্মী। প্রাচীরের ভেতরে বাড়ির সামনের অংশে পাইন, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আছে। আঙিনায় আছে সবুজ ঘাস।

তবে হোঁচট খেতে হলো ভবনসহ পুরো বাড়ি ঘুরে। ভবনের বেশ কয়েকটি দরজা-জানালা ভাঙা। বেশির ভাগ আসবাব নষ্ট। বাড়ির গ্যারেজের অবস্থাও খারাপ। সব মিলিয়ে বাড়িটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী।

গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, বাড়িটি সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করতে অন্তত তিন মাস লাগবে।

বাড়ির বেশ কয়েকটি জায়গায় ঝোপঝাড়ও দেখা গেল। এ ছাড়া বাড়ির ভেতরে আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলাসহ বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে। সেখানে শীতকালীন সবজি দেখা গেল। ভেতরে ঢুকে কথা হয় লাল মিয়া ও কামাল হোসেনের সঙ্গে। বলেন, তাঁরাই এসব সবজি লাগিয়েছেন।

বাড়িটির পেছনের অংশে বেশ কয়েকটি আধপাকা টিনশেড ঘর। সেখানে কয়েকটি পরিবার থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসভবনের তিনজন কর্মচারী—মালি লাল মিয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কামাল হোসেন ও পানির লাইনের মিস্ত্রি (প্লাম্বার) আকরাম হোসেনের পরিবার।

এ সময় কথা হয় রায়হান আহমেদ নামের একজনের সঙ্গে। তিনি নিজেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশকনিধনকাজে যুক্ত বলে পরিচয় দেন। তাঁর ভাষ্য, তিনি এক বছর আগে এখানে উঠেছেন। আগে তিনি থাকতেন রমনা পার্কের ভেতরের একটি ঘরে। সেটি ভেঙে ফেলার পর তিনি এখানে ওঠেন।

টিনশেড ঘরে বসবাসরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুটি টিনশেড ঘরে ১০ জন ব্যাচেলর ভাড়া থাকেন। তাঁরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত। পরিবার নিয়ে আলাদা ঘরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ওসমানী উদ্যানের এক পাহারাদার, গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর গাড়িচালক ও মিন্টো রোডে অবস্থিত মসজিদের ইমাম। সব মিলিয়ে ছয়টি পরিবার, ব্যাচেলরসহ অন্তত ৩০ জন টিনশেড ঘরে থাকছেন।

গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির (জাপা) রওশন এরশাদ বাড়িটি বরাদ্দ চেয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। তবে তখন তাঁর নামে বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাড়িটি বরাদ্দের জন্য চিঠি দেন। তখন বাড়িটি তাঁর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে তিনি বাড়িটিতে ওঠেননি। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির জি এম কাদের বাড়িটি বরাদ্দ চেয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে এখনো তিনি বরাদ্দ পাননি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত সরকারি বাড়িতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালি ও প্লাম্বার আছেন। এর বাইরে সেখানে আর কারও থাকার সুযোগ নেই। তবে বাড়িটি দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকায় অনেকে সুযোগ নিচ্ছেন বলে মনে করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব হাসান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদলীয় নেতা ওই বাড়িতে বসবাস করেন না। যে কারণে বাড়িটির জন্য নির্ধারিত পদের লোকজনের বাইরের কেউ কেউ সেখানে থাকার সুযোগ নিচ্ছেন। তবে বিরোধীদলীয় নেতা যখনই ওই বাড়িতে উঠবেন, তখন বাইরের লোকদের চলে যেতে হবে।

বাড়িটি সংস্কার না করার বিষয়ে মাহবুব হাসান বলেন, ‘যেহেতু সেখানে কেউ থাকেন না, তাই সংস্কার করেও লাভ নেই। যখন বিরোধীদলীয় নেতা বাড়িতে উঠবেন, তখন বাড়িটির সংস্কারকাজে হাত দেওয়া হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.