সমন্বিত সফটওয়্যার চালু হবে সব ব্রোকারেজ হাউসে

বিএসইসির নতুন নির্দেশনা

0
151
বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থের সুরক্ষায় শেয়ারবাজারে সমন্বিত ব্যাক অফিস সফটওয়্যার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে এ ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ।

শেয়ারবাজারে আগামী বছরের মার্চ থেকে চালু হচ্ছে সমন্বিত ‘ব্যাক অফিস সফটওয়্যার বা বিওএস বা বস’। এ ব্যাক অফিস সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থের হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। তাই সফটওয়্যারের মাধ্যমে যাতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থের হিসাবে কোনো গড়মিল না হয়, সে জন্য সমন্বিত সফটওয়্যার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গত সোমবার বিএসইসির পক্ষ থেকে এ–সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যভুক্ত সব ব্রোকারেজ হাউসকে এ সমন্বিত সফটওয়্যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে সমন্বিত এ সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য নীতিমালা বা গাইডলাইন তৈরির জন্যও দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই নীতিমালার আলোকে এ বছরের মধ্যে সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে বলা হয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে। অর্থাৎ স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত সরবরাহকারীদের কাছ থেকেই সমন্বিত এ সফটওয়্যার সংগ্রহ করতে হবে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে।

তবে যেসব ব্রোকারেজ হাউস এরই মধ্যে নিজস্ব উদ্যোগে ব্যাক অফিস সফটওয়্যার তৈরি করে ফেলেছে, সেসব ব্রোকারেজ হাউসকে স্টক এক্সচেঞ্জের তৈরি করা নীতিমালা মেনে ওই সফটওয়্যারের বিপরীতে সনদ নিতে হবে। অর্থাৎ স্টক এক্সচেঞ্জ অনুমোদিত বা এক্সচেঞ্জের সনদপ্রাপ্ত ব্যাক অফিস সফটওয়্যারই ব্যবহার করতে হবে সব ব্রোকারেজ হাউসকে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমন্বিত বিওএস চালু হলে তাতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অনিয়ম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, সমন্বিত সফটওয়্যার চালু হলে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে অনিয়ম কমে আসবে। কারণ, স্টক এক্সচেঞ্জের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রোকারেজ হাউস এ সফটওয়্যারের কোনো তথ্য বা ডেটা পরিবর্তন বা মুছে ফেলতে পারবে না। আবার এ সফটওয়্যারের পাসওয়ার্ডও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর হাতে রাখা হবে না। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিএসইসি বলছে, শেয়ারবাজারে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ব্যাক অফিস সফটওয়্যারে অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এত দিন ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের নিজেদের পছন্দের সফটওয়্যার ব্যবহার করে আসছিল। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনো সফটওয়্যার ছিল না। এত দিন ব্রোকারেজ হাউসগুলো যেসব ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করছিল, সেগুলোর অনেকগুলোতে চাইলে সংরক্ষিত তথ্য বা ডেটা পরিবর্তন ও মুছে ফেলার সুযোগ ছিল। আর পরিবর্তন বা মুছে ফেলার তথ্য সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ তছরুপের সুযোগ ছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ব্যাক অফিস সফটওয়্যারের অপব্যবহার করে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো বিনিয়োগকারীরা  তাঁদের তছরুপ হওয়া অর্থ ও শেয়ার ফেরত পাননি। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে চারটি ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। ব্রোকারেজ হাউসগুলো হলো তামহা সিকিউরিটিজ, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বাংকো সিকিউরিটিজ ও শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোং।

বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোন ব্রোকারেজ হাউস কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করবে, তার জন্য অনুমতি নিতে হয় স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে। কিন্তু একশ্রেণির ব্রোকারেজ হাউস অনুমতি না নিয়েই নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। শুধু তা–ই নয়, বিকল্প সফটওয়্যার ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করছে। গত বছর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউসের সফটওয়্যার ব্যবহারের অনিয়ম ধরা পড়ে।

গত বছর বিএসইসির নির্দেশে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর জানতে পারে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর একটি সফটওয়্যারের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। শেয়ার সংরক্ষণ ও লেনদেন নিষ্পত্তিকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সঙ্গে সরাসরি সংযুক্তিও নেই অনেক সফটওয়্যারের। ফলে ব্রোকারেজ হাউসগুলো সহজেই সফটওয়্যারের ডেটা বদলে (এডিট) ফেলতে পারে।

গত বছর ডিএসইর পক্ষ থেকে বিএসইসির কাছে ২৩৫টি ব্রোকারেজ হাউসের সফটওয়্যার ব্যবহারের তালিকা পাঠানো হয়। ওই তালিকায় বলা হয়, এসব ব্রোকারেজ হাউসে ১৯টি ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে রয়েছে, শেয়ার ইনপুট সিস্টেম প্লাস (সিআইএস প্লাস), এডিএ সফট, এডিএ সফট ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাসোসিয়েশন ফর সার্ভে অ্যান্ড প্রোগ্রামিং সিস্টেম (এএসএপিএস), আই স্টকব্রোকিং, আইকনিক ট্রেড, আবু সফট, জেডএবি-ইআরপি, ব্লু চিপ, ক্যাপিটা, রয়েল ব্যাক অফিস, এক্সব্রোকার, বিজনেস অবজেক্ট সলিউশন, ব্রোকারস ব্যাক অফিস ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড প্লাস, কে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কনসালট্যান্টস, কানেক্ট সফটওয়্যার, স্পার্কটেক সফট ইন্টারফেস এবং টেকনো ক্যাপিটাল। এই ১৯টি সফটওয়্যারের বাইরে এইচইউবি, এম ব্যাংক এবং শুভ্র সিস্টেম নামে আরও তিনটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে।

তবে এসব সফটওয়্যার সরবরাহকারী বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই কোনো ওয়েবসাইট নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্কে তথ্য জানারও কোনো উপায় নেই। তাদের কোনো সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশনও নেই।

এমন এক পরিস্থিতিতে বিএসইসি শেয়ারবাজারে সমন্বিত বিওএস বা ব্যাক অফিস সফটওয়্যার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। সংস্থাটি বলছে, আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে যেসব ব্রোকারেজ হাউস সমন্বিত সফটওয়্যার ব্যবহার করবে না, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব ব্রোকারেজ হাউস প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে কোনো কোটাসুবিধা পাবে না। আবার স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা শেয়ারের বিপরীতে ব্রোকারেজ হাউসগুলো লভ্যাংশ বিতরণও স্থগিত থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.