বাধার আশঙ্কায় আগামী বৃহস্পতিবারের মহাসমাবেশে যোগ দিতে আগেভাগে ঢাকায় আসছেন বিএনপির নেতাকর্মী। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফার আন্দোলনে সাড়া ফেলতে এ কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগমের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করা হবে– নেতারা এ ঘোষণা দিলেও বিএনপি সূত্রের খবর, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে টানা অবস্থানের চিন্তা নেই।
গত বছর বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের সময় মালিক-শ্রমিকদের ‘ধর্মঘটে’ গণপরিবহন বন্ধ হয়। দলটির নেতাকর্মীর আশঙ্কা, মহাসমাবেশে জমায়েত ঠেকাতে এবারও গাড়ি বন্ধ হতে পারে। স্থানীয় পরিবহন নেতারা ভাঙচুরের আশঙ্কা দেখিয়ে গণপরিবহন বন্ধের ইঙ্গিত দিলেও কেন্দ্রীয় মালিক সমিতি বলেছে, গণপরিবহন চলবে। তবে এবার পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানি বা সমাবেশের প্রস্তুতিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ নেই বিএনপি নেতাদের।
অবশ্য এবারও বাধার আশঙ্কা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এত কিছুর পরও বিএনপির কোনো সমাবেশকে তারা আটকাতে পারেনি। নৌকায় কিংবা কলাগাছের ভেলায় নদী পার হয়ে, হেঁটে, এমনকি নদী সাঁতরে কর্মীরা কর্মসূচিতে এসেছেন।
গত ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে অনড় ছিল বিএনপি। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলেছিল। সমাবেশস্থল নিয়ে সংঘাতে বিএনপির এক কর্মী নিহত হন। আহত ও গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকে। এবার সমাবেশস্থল নিয়ে নমনীয় বিএনপি। জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে (ডিএমপি) দেওয়া চিঠিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, অতীতে বিএনপি জেলা ও গ্রামীণ এলাকায় শক্ত অবস্থান নিতে পারলেও ঢাকায় আন্দোলন জমাতে না পারায় দাবি আদায় করতে পারেনি। তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতায় স্পষ্ট, নির্বাচনের বছরে দলটির লক্ষ্য রাজধানীর রাজপথে শক্তভাবে থাকা।
কম্বোডিয়ায় বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের এক দিন পর গতকাল সোমবার দেশটির নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র; মার্কিন সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন হলে একই পদক্ষেপ আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তারা এতে আগের তুলনায় উজ্জীবিত। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনগুলো বৃহস্পতিবার পাল্টা সমাবেশ ডাকলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেবে না বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপি মহাসচিব অবশ্য বলেছেন, এক দফা জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। মহাসমাবেশ সফল করতে জনগণ নেমে পড়েছে। আওয়ামী লীগ বাদে সব রাজনৈতিক দল বলছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
মহাসমাবেশ সফলে গতকাল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা, বিভাগীয় ও বৃহত্তর ঢাকার নেতারা যৌথ সভা করেন। মেডিকেল টিম, শৃঙ্খলা কমিটি, আপ্যায়ন কমিটি, মঞ্চ কমিটি গঠন করা হয়। সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীকে ঢাকায় জমায়েত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরিবহন বন্ধ হলে, ঢাকার প্রবেশপথে বাধা থাকলে, হামলা হলে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে– সে বিষয়ে আলোচনা হয়। দলের সব শাখাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আগ বাড়িয়ে সংঘাতে জড়ানো যাবে না। যাতে সরকার চলমান আন্দোলনকে সহিংস কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে-বিদেশে সুযোগ নিতে না পারে।
মহাসমাবেশ থেকে টানা অবস্থানের পরিকল্পনা নেই বিএনপির। দলটির একজন নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে আগামী কয়েক মাসে আন্দোলনকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া হবে। এ মুহূর্তে সড়কে বসে গেলে সরকার কঠোরভাবে তা দমন করবে। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করতে পারলে তবেই টানা অবস্থানের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচির দিকে যাওয়া হবে।
বৈঠকে উপস্থিত তিনজন নেতা বলেছেন, বাধা এড়াতে মঙ্গল ও বুধবারের মধ্যে নেতাকর্মীকে চলে আসতে বলা হয়েছে। গত শনিবার তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিতে আসা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অনেকে নিজ এলাকায় পদযাত্রার মামলায় গ্রেপ্তার-হয়রানি এড়াতে ঢাকায় রয়ে গেছেন।
বরিশাল জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক এমরান হোসেন জানান, বাধার আশঙ্কায় সোমবার চলে এসেছেন।
খুলনার ছাত্রদল নেতা নেয়ামুল হক জানান, তারুণ্যের সমাবেশের পর ঢাকায় আছেন।
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, দলের নীরব সমর্থকদের কর্মসূচিতে আনতে বাজার-মহল্লাকেন্দ্রিক ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানার নেতাকর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, এবার দেশ বাঁচানোর আন্দোলন। তরুণ-যুবকরা রয়েছেন সামনের কাতারে। মহাসমাবেশে রেকর্ড জনসমাগম হবে।
বাস বন্ধের ইঙ্গিত, পরিবহন নেতার নাকচ
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলা থেকে বিএনপির অনেকে এরই মধ্যে ঢাকায় চলে গেছেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের দাবি, কিশোরগঞ্জের চার হাজার নেতাকর্মীর মহাসমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
বাস বন্ধের শঙ্কা থাকলেও এখনও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দেয়নি, হয়রানি করেনি বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা।
বাস বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মানিক। তিনি জেলা আওয়ামী লীগেরও কোষাধ্যক্ষ। হেলাল উদ্দিন মানিক বলেছেন, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে অনেক বাসে আগুন দেওয়া হয়; অনেক পরিবহন শ্রমিক নিহত হন। আগে সরকার ক্ষতিপূরণ দিত। এখন দেয় না। বিএনপির কর্মসূচিতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় তাই বাস চলাচল বন্ধ হতে পারে।
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, গণপরিবহন বন্ধের নির্দেশনা কাউকে দেওয়া হয়নি। কেউ বলে থাকলেও তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত। বিএনপির কর্মসূচির বা অন্য কোনো কারণে পরিবহন ধর্মঘটের আশঙ্কা নেই।
বিএনপিতে বিভক্তি
খুলনা ব্যুরো জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বললেও খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির বর্তমান কমিটির নেতৃত্বে এবং সাবেক নেতা মঞ্জু-মনি গ্রুপের নেতাকর্মী পৃথকভাবে ঢাকায় যাচ্ছেন। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা জানান, হাজারের বেশি নেতাকর্মী ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী জানান, সমাবেশের আগের দিন বাস বন্ধের আশঙ্কায় নেতাকর্মী যে যার মতো ঢাকায় যাবেন। তবে এখন পুলিশের তল্লাশি বা আটকের খবর নেই।
মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অনুসারী সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম জানান, তাদের হাজারের বেশি নেতাকর্মী ঢাকায় যাবেন। গত রোববার সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান মনির কার্যালয়ে প্রস্তুতি সভা হয়েছে।
বগুড়া ব্যুরো জানিয়েছে, বিএনপি অধ্যুষিত এ জেলা থেকেও নেতাকর্মী আগেভাগে যাচ্ছেন ঢাকায়। ১৬ জুলাই বিএনপির পদযাত্রার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় চারটি মামলায় দলটির ২১ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম খায়রুল বাসার বলেন, নেতাকর্মীরা জামিন নিতে ঢাকায় আছেন। মহাসমাবেশ শেষ করে ফিরবেন।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আক্তার বলেন, শুধু আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অন্য কাউকে ধরার ইচ্ছা নেই পুলিশের।