বাঘটি আমার ঘাড় কামড়ে ধরে

0
79
পেটের তাগিদেই সুন্দরবনে যান বনজীবীরা

নৌকায় বসে কাঁকড়া ধরতে ধরতে সুন্দরবনের গহিনে ঢুকে পড়েছিলেন দুই ভাই। এই করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আচমকা একটা বাঘ এসে কামড় বসায় বড় ভাই ওয়াজেদ আলীর ঘাড়ে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও একসময় ভাইকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে ছোট ভাই লিয়াকত। তারপর? ওয়াজেদ আলীর কাছে সেই রুদ্ধশ্বাস গল্প শুনেছেন কল্যাণ ব্যানার্জি

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ—নির্মম এই সত্য মেনেই পেটের তাগিদে প্রতিবার সুন্দরবনে যাই।

শুরুতে দাদা ফজর আলীর সঙ্গে যেতাম। সে প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ১০ কি ১২ বছর। তারপর বাবা আবদুল জব্বারের সঙ্গী হই। তাঁরা শিখিয়েছেন কীভাবে বনে সুরক্ষিত থাকা যায়, হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা যায়। সেই শিক্ষা নিয়েই চলছি। এখন বনযাত্রায় আমার সঙ্গী ছোট ভাই লিয়াকত।

গত ২৪ মার্চ ভোরেও দুই ভাই নৌকা নিয়ে চুনকুড়ি নদী দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকি। তারপর এই নদী, ওই খাল হয়ে পৌঁছে যাই কাছিকাটা দাড়গাং। এটা ভারত সীমান্তবর্তী রায়মঙ্গল নদের একটা শাখা খাল। নৌকার দুই পাশে দুই ভাই বসে পেতে রাখা দোন (কাঁকড়া শিকারের বড়শি) তুলছিলাম। ভালোই কাঁকড়া পড়েছিল। তুলে তুলে বাক্সে রাখছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাশেই হেঁতালবন। তারপর বড় গাছগাছড়ার ঘন বন।

হেঁতালবনেই সাধারণত বাঘ থাকে। তবে বাঘ থাকলে বা হঠাৎ চলে এলে চারপাশের পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়। যেমন বাঘ দেখলেই হরিণ ছোটাছুটি শুরু করে, বানর তিড়িংবিড়িং করে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যায় আর আওয়াজ করতে থাকে, অন্য পাখি ও প্রাণীর মধ্যেও চঞ্চলতা লক্ষ করা যায়। এসব দেখে আমরাও সতর্ক হই।

আমাকে কুমিরে ধরেছিল

বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসার পর বাড়িতেই চিকিৎসা নেন ওয়াজেদ আলী। তাঁর পাশে বসে আছেন ছোট ভাই লিয়াকত আলী (বাঁয়ে)
বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসার পর বাড়িতেই চিকিৎসা নেন ওয়াজেদ আলী। তাঁর পাশে বসে আছেন ছোট ভাই লিয়াকত আলী (বাঁয়ে)

সেই সন্ধ্যায় কিন্তু সবকিছুই ছিল সুনসান, চারপাশে শুধু প্রকৃতির নিজস্ব আওয়াজ। আর ডাঙা থেকেও প্রায় ১৪-১৫ হাত দূরে, খালের মধ্য নৌকায় ছিলাম আমরা। ফলে নিশ্চিন্ত মনেই দোন তুলছিলাম। এমন সময় আচমকা একটা শব্দ হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের বেগে একটা বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে খামচে ধরল। ঘাড় ও মাথা বরাবার কামড়ও বসাল। মোটা একটা গামছা ছিল ঘাড়ে। তাই ভালোমতো দাঁত বসাতে পারল না। তখন সামনের দুই পা দিয়ে আমাকে বশে নেওয়ার চেষ্টা করল। বাঘের ধাক্কা সামলাতে না পেরে এ সময় হুড়মুড় করে নৌকা থেকে পড়ে যাই। বাঘটাও আমার সঙ্গে পানিতে পড়ে যায়। গলাসমান পানি। খালি হাতেই বাঘের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করি। ওর চোখে আঘাত করতে থাকি।

ঘটনার আকস্মিকতায় শুরুতে থতমত খেয়ে গিয়েছিল লিয়াকত। তারপরই সে বৈঠা দিয়ে বাঘকে পেটাতে থাকে, চোখে-মুখে আঘাত করতে থাকে। আমরা দুই ভাই এভাবে তিন-চার মিনিট পানিতে বাঘের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাই। বাঘটি এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে ডাঙায় উঠে সোজা বনের ভেতরে চলে যায়।

পানি থেকে আমাকে টেনে নৌকায় তোলে লিয়াকত।

আর বনে যাব না

আমার ঘাড়সহ শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়ছিল। প্রথমে আমার গায়ের গেঞ্জি দিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলে লিয়াকত। তারপরও রক্ত পড়া কমছিল না। তখন নিজের গায়ের গেঞ্জি খুলে আমাকে বাঁধে। একটু সরে এসে লতাপাতা দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে। তারপর শুরু হয় লোকালয়ে ফেরার যাত্রা।

সে এক বিভীষিকাময় মুহূর্ত। ব্যথায় আমি কাতরাচ্ছি। ছোট ভাইটা সর্বশক্তি দিয়ে নৌকা বাইছে। একা নৌকা বাওয়া যে কী কঠিন, আমরা বনজীবীরা তা ভালো বুঝি। এভাবে সময় পেরোয়, আমার মধ্যে মৃত্যুভয় চেপে বসে। মনে হয়, আর বোধ হয় বাঁচব না। কখন ফিরব পাড়ে, পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আবার দেখা হবে তো? এসব ভেবে ভেবে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, মনে নেই।

পরে জেনেছি, সকালের দিকে আমাকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছায় লিয়াকত। তারপর এলাকার চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। কাউকে বাঘে ধরলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে জানাতে হয়। এতে কিছু সহায়তা পাওয়া যায়। চেয়ারম্যান সাহেব খবর শুনে আমাকে হাসপাতালে নিতে বলেন। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বাধ্য হয়ে গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা শুরু হয়। সেই থেকে তাঁর কাছেই চিকিৎসা নিচ্ছি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আমাদের বাড়ি। গ্রামের নাম ছোট ভোটখালী। গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চুনকুড়ি। নদীর এক পারে গ্রাম, আরেক পারে সুন্দরবন। গ্রামের সবাই বনের ওপর নির্ভরশীল। বাঘের ভয়ে একমাত্র ছেলেকে বনে যেতে দিই না। শেষে কিনা সেই বাঘের কবলে আমিই পড়লাম।

দুই মাস হতে চলল, এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। শরীরে দগদগে ঘা। তার চেয়ে বড় ঘা মনে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমিও আর বনে যাব না। অন্য কোনো পেশা বেছে নেব। আমার ভাই লিয়াকতও বন ছেড়ে দিয়েছে। আমি যে কাজ করব, সেও তা–ই করবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.