বরেন্দ্র অঞ্চলে অনুমোদনহীন হাজারো সেচপাম্প

0
142
মুরগির খামারের নামে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে বসানো হয়েছে সেচপাম্প। ৩ জুলাই রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে

চাষাবাদে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) আট বছর আগে থেকে নতুন করে গভীর নলকূপ না বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য চাষিদের পানি সাশ্রয়ী ফসল চাষেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাষিরা সেই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না। পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো থেকে আবাসিক বা ক্ষুদ্রশিল্পের নামে সংযোগ নিয়ে নলকূপ বসিয়ে সেচপাম্প চালাচ্ছেন অনেকে।

অভিযোগ উঠেছে, অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা কৌশলে মুরগির খামার, সবজি চাষ বা আবাসিক বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তুলছেন। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন সেচপাম্প বসাতে হলে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। কেউ তা মানছেন না। শুধু তানোর উপজেলাতেই অনুমোদনহীন প্রায় আড়াই হাজার সেচপাম্প রয়েছে।

এভাবে চলতে থাকলে পানির স্তর আরও নিচে যাবে উল্লেখ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহানবলেন, বরেন্দ্র এ লাকায় বহুমুখী সংকট তৈরি হবে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। সর্বোপরি, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে।

অনুমোদনহীন সেচপাম্পের খুঁজে ৩ জুলাই তানোরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। রাস্তার পাশে ছোট ছোট মুরগির খামার দেখা গেল, যার অধিকাংশই খালি। কোনোটিতে মুরগি নেই। কিন্তু এসব খামার ঘেঁষে বসানো হয়েছে সেচযন্ত্র। সেটি থেকে পাশের জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। উপজেলার দুবলই মাঠে রাস্তার ধারে এমন একটি মুরগির খামারে সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল। তাতে লেখা আছে, ‘মোহাম্মদ আলী পোলট্রি খামার। স্বত্বাধিকারী: শফিকুল ইসলাম।’ খামারে চার-পাঁচটি দেশি মুরগির বাচ্চা রাখা হয়েছে। আর কোনো মুরগি নেই; বরং খামারের ঘরের সঙ্গে সেচ দেওয়ার জন্য প্লাস্টিকের কয়েকটি পাইপ বাঁধা। ঘরের পাশেই বসানো হয়েছে নলকূপ। এ সময় খামারে কাউকে পাওয়া যায়নি।

কথিত এই মুরগির খামারের মালিক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্বীকার করেন, মুরগির খামারের সংযোগ থেকে সেচকাজ চালাচ্ছেন। ১০ থেকে ১২ বিঘা জমি আবাদ করেন। তাঁর দাবি, তিনি একা নন, বহু মানুষ এভাবে সংযোগ নিয়ে জমিতে সেচ দেন। এ জন্য তাঁরা বাণিজ্যিকভাবে পল্লী বিদ্যুৎকে বিল দেন। তিনি বলেন, এভাবে না করলে তাঁদের জমি অনাবাদি পড়ে থাকবে। তাঁরা ধান চাষ করতে পারবেন না।

বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে তাদের ১৭ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ চালু আছে। শুধু রাজশাহী জেলায় প্রায় ২ হাজার ৮০০ গভীর নলকূপ চলমান। সঙ্গে ব্যক্তিমালিকানাধীন নলকূপও আছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ২০১৫ সাল থেকে বিএমডিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা নতুন করে কোনো গভীর নলকূপ বসাবে না। নতুন করে কেউ নলকূপ বসাতে চাইলে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। ওই কমিটির প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সদস্যসচিব বিএমডিএর স্থানীয় সহকারী প্রকৌশলী।

সেচ কমিটির অনুমতি না নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও অনেকে সেচপাম্প বসাচ্ছেন বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন। অনুমোদনহীন সেচপাম্পগুলো দেড় শ থেকে দুই শ ফুট গভীর পর্যন্ত বসানো হচ্ছে। উপজেলার চোরখৈর গ্রামের কৃষক ও আওয়ামী লীগের কর্মী শামসুদ্দিন অনুমোদনহীন একটি পাম্প বসিয়েছেন। মুরগির খামার অথবা আবাসিক সংযোগ দেখিয়ে তিনি সেচপাম্পে বিদ্যুৎ নিয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পাম্প বসানোর কথা স্বীকার করেছেন শামসুদ্দিন। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই নেতার নাম উল্লেখ করে তিন বলেন, তাঁরা তদবির করে দিয়েছেন। তাঁর কাজ হয়ে গেছে। মুরগির খামার নাকি আবাসিক সংযোগ দেখানো হয়েছে, তা তিনি বলতে পারবেন না।

কৃষি কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার মধ্যে বেশি ধান উৎপাদিত হয় তানোরে। সেখানে সেচের আওতায় আছে ২২ হাজার ৩৩২ হেক্টর জমি। বিপরীতে সেচযন্ত্র আছে ২ হাজার ১৯৫টি। এর মধ্যে বিএমডিএর গভীর নলকূপ ৫২৯টি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ ১৬টি। বাকিগুলো অগভীর নলকূপ। এর বাইরে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার অনুমোদনহীন নলকূপ। তানোরের কয়েকজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এলাকার কৃষকদের ধানের বদলে পানি সাশ্রয়ী ফসল শর্ষে, তিল, মসুর ও ভুট্টা চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মদ।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ  বলেন, আবাসিকের সংযোগ নিয়ে, কেউ কেউ ক্ষুদ্রশিল্পের নামে সংযোগ নিয়ে সেচকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের সঙ্গে তাঁদের কয়েক দফা চিঠি-চালাচালি হয়েছে।

জানতে চাইলে পল্লী বিদ্যুৎ তানোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জহুরুল ইসলাম বলেন, জমিতে ধান থাকায় মানবিক কারণে তাঁরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। কেউ আবাসিক বা মুরগির খামারের মিটার থেকে সংযোগ নিয়ে সেচ দিলে তাঁদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে—এই মর্মে গত মে থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ বিলের কাগজে সিল মেরে দিচ্ছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.