হালিম। ইফতারির তালিকায় যে নামটি থাকে প্রথম সারিতেই। চার-পাঁচ ধরনের ডাল, মাংস, ঘি আর হরেক রকম মসলার মিশেলে তৈরি এ খাবারে বুঁদ হয়ে থাকেন ভোজনরসিকেরা। ইফতারে রসনাতৃপ্তিই যেন মেলে মুখরোচক এ খাবারে। কথায় যেমন আছে ‘ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়’, তেমনি হালিমের এই অনন্য স্বাদ তৈরিতে প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সময়। কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে তৈরি করতে হয় হালিম। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, এই দীর্ঘ সময়ের সঙ্গে হালিমের নামের সম্পর্কও জড়িয়ে রয়েছে। আরবদের খাবার ‘হারিশা’ই নাকি ক্রমে বাংলায় এসে হালিম নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই হারিশা শব্দের অর্থ ‘ধৈর্যশীল’।
নানা দেশ পেরিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আজকের হালিম নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে রাজধানী ঢাকায় কাজ করছে ‘ডিসেন্ট’। এবারের রমজানে হালিম নিয়ে অনলাইন খাবার সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফুডপান্ডা’ যোগ করেছে নতুন এক মাত্রা। ডিসেন্টের হালিম নিয়ে ঢাকাবাসীর মাতামাতি থাকলেও অতুলনীয় স্বাদের এই হালিম সহজপ্রাপ্য ছিল না বনানী-গুলশানসংলগ্ন বাসিন্দাদের কাছে। খাবারের স্বাদ যেমন কোনো বেড়াজাল মানে না, তেমনি ফুডপান্ডার বাহারি ইফতার আয়োজনও ঘুচিয়েছে এই দুষ্প্রাপ্যতার বাধা।
বনানীর ডিএনসিসি ফুড কোর্টে আয়োজিত ‘গ্র্যান্ড ইফতার টেকঅ্যাওয়ে ফেস্ট’ নামের ইফতারি উৎসবে মিলছে ঐতিহ্যবাহী ডিসেন্টের এই নবাবি হালিম। এর ফলে দীর্ঘ পথ আর লম্বা লাইন পেরিয়ে অতুলনীয় স্বাদের এ হালিমের সহজলভ্যতা এখন ঢাকার এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তৃপ্তি ও আনন্দের কারণ হয়ে উঠেছে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ডিসেন্ট পেস্ট্রি শপের হালিম এখন ঢাকাবাসীর মুখে মুখে সমধিক উচ্চারিত হয়। পবিত্র রমজান মাসজুড়েই এই নবাবি হালিম বিক্রি করে তারা। মান আর স্বাদ ধরে রাখার জন্য পুরান ঢাকার একটি কিচেনেই তৈরি হয় এই হালিম। এরপর পৌঁছে দেওয়া হয় অন্যান্য শাখায়।
ইফতারের আগে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ডিসেন্টের হালিম কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। দুপুরের পর থেকেই এখানে বাড়তে থাকে ভিড়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোজনরসিকেরা এই হালিম কিনতে আসেন। ডিসেন্টের নবাবি হালিমের জনপ্রিয়তার সঙ্গে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার আয়োজনের সাংস্কৃতিক পরম্পরাও জড়িয়ে রয়েছে।
হারিশা থেকে হালিম নামের যেমন এক বিবর্তন ধারা রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বাদেও। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতে এসে হারিশায় আরও নানা পদের মসলা যুক্ত হয়ে জনপ্রিয় হয়েছে হালের এই হালিম। আর বাংলাদেশে ডিসেন্টের নবাবি হালিম স্বাদে তৈরি করেছে নিজস্বতা। সাধারণত মাংসের টুকরা আর ডালের মিশ্রণে যে হালিম আমরা দেখি, তার সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে ডিসেন্টের তৈরি হালিমের। ঝুরা মাংসের সঙ্গে ডালের সমারোহে তৈরি হয় অনন্য স্বাদের এই হালিম।
গ্র্যান্ড ইফতার টেকঅ্যাওয়ে ফেস্টে এসেছিলেন গুলশান–সংলগ্ন বাড্ডায় বসবাসরত নাজ্জার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলাম। ফুডপান্ডার বনানীর ইফতার উৎসবে ঢুঁ মারতেই চোখে পড়ল ডিসেন্টের স্টল। নবাবি হালিমের নাম অনেকের কাছে শুনলেও ডিসেন্টের দোকান দূরে হওয়ায় কখনো এটি চেখে দেখা হয়নি। হাতের নাগালে পেয়ে তাই ফুডপান্ডার পিকআপ দিয়ে কিনে ফেললাম নবাবি হালিম।’
একটু দূরেই চোখ পড়ল গোলাপি টি-শার্ট গায়ে জড়ানো এক রাইডারের দিকে। ব্যস্ত রাইডার জানান, ‘ডিসেন্টের হালিম নিয়ে যাচ্ছি নিকেতনে। ঘড়িতে তখন তিনটা বাজে। বনানীতে আয়োজিত ফুডপান্ডার এ উৎসবে ভিড় ক্রমে বাড়ছে। রাইডার আর ক্রেতায় জমে উঠেছে উৎসব প্রাঙ্গণ। একদল যুবক কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তাঁদের একজন জানালেন, চলতি পথের ক্রেতারা ফুডপান্ডা অ্যাপের পিকআপ দিয়ে এ উৎসব থেকে খাবার কিনতে পারছেন। মুঠোফোনে ফুডপান্ডার অ্যাপ না থাকলে তাৎক্ষণিক অ্যাপ ইনস্টল করে দেওয়া হচ্ছে। ঘরে বসেও বনানী-গুলশানসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত ব্যক্তিরা অ্যাপ দিয়ে এখান থেকে বাহারি আইটেমের ইফতারি কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। ডিসেন্ট ছাড়াও এ উৎসবে অংশ নিয়েছে জয়পুর সুইটস, ধানমন্ডির বারবিকিউ টুনাইট, ঢাকা মেট্রো, তার্কা, ট্রাই স্টেট ইটারি, ইফতার ওয়ালা, সুলতানস ডাইনস, হাজি নান্না, জ্যাকসন ফ্রাইড চিকেনের মতো নামকরা সব রেস্তোরাঁ।
ডিসেন্টের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, নবাবি হালিম ছাড়াও ডিসেন্টের স্টলে মিলছে কাশ্মীরি শরবত, দইবড়া, চিকেন সমুচা, বিভিন্ন রকম পরোটা, চিকেন দম বিরিয়ানিসহ হরেক স্বাদের খাবার।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই আজানের পবিত্র সুর ভেসে আসে। সারা দিন রোজা পালন শেষে কেউ বন্ধু বা পরিবারের সদস্য, কেউবা স্বজনদের নিয়ে বসে পড়েন ইফতারের টেবিলে। সন্ধ্যাগুলো তখন হয়ে ওঠে সৌহার্দ্যের, ভ্রাতৃত্বের। সঙ্গে উচ্ছ্বাস যোগ করে হরেক রকম ইফতারির বাহারি স্বাদ।