একদিকে নিম্নচাপ, অন্যদিকে শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমা। এর জেরে গত দু’দিন ধরে উত্তাল সাগর। উপকূলে দেখা দিয়েছে জলোচ্ছ্বাস, তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের ছোট-বড় ১০টি স্পটে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভেঙে যাওয়া অংশ এখনই মেরামত করা না হলে মেরিন ড্রাইভ সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জোয়ারের চাপে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উপকূলের হাজার হাজার মানুষ। ভেসে গেছে মাছের ঘের।
বৃহস্পতিবার সকালে মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ পশ্চিম মুন্ডার ডেইল এলাকার প্রায় ৬০ মিটার সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে গেছে। এ ছাড়া গত দু’দিনে বাহারছড়া, হাদুরছড়া, দক্ষিণ মুন্ডার ডেইল এলাকার ১০টি স্পটে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নতুন করে ভাঙছে। স্থানীয়রা বলছেন, সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সড়ক রক্ষার জিও ব্যাগ দুর্বল হয়ে গেছে। এ ছাড়া আইন অমান্য করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাছ থেকে অনেকে বালু তুলে জমি ভরাট করেছে। এ কারণে সাগরে সামান্য পানি বাড়লে এ রুটে ভাঙন দেখা দেয়। স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, এর আগে কখনও এভাবে ভাঙন ধরেনি মেরিন ড্রাইভ সড়কে। সাগরে ঢেউয়ের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে জিও ব্যাগ টপকে পানি সড়কে উঠেছে। যার কারণে সড়কে ভাঙন ধরেছে।
টেকনাফের ইউএনও কামরুজ্জামান বলেন, ‘সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি। মেরিন ড্রাইভ সড়কের কয়েকটি স্পটে ভাঙন ধরেছে। তবে ভাঙন রোধে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। খুব কম সময়ে এই সমস্যার সমাধান হবে।’ কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফিন বলেন, ‘ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হবে। পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভ সড়ক রক্ষায় সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।’
মেরিন ড্রাইভ সড়ক ছাড়াও জোয়ারের পানির ধাক্কায় কক্সবাজারের পেকুয়ার কাটাফাঁড়ি ব্রিজ-করিমদাদ মিয়া চৌধুরী জেটিঘাট সড়কের তিনটি পয়েন্ট ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। এতে উজানটিয়া ও মগনামা ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষের পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার প্রভাবে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পটুয়াখালী উপকূলের রাঙ্গাবালী উপজেলার পাঁচ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে– উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চর আন্ডা, চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের উত্তর চালিতাবুনিয়া, গরু ভাঙ্গা, কুলের চর ও মরাজঙ্গী। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত পানিবন্দি ছিল এসব গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার। জোয়ারের পানি পটুয়াখালী পৌর শহরের অভ্যন্তরেও ঢুকে পড়লে দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ও সড়ক তলিয়ে যায়। পটুয়াখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র দেলোয়ার হোসেন আকনের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার নদনদীতেও স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন ফুট জোয়ারের পানি বেড়েছে। এতে দুর্বল বাঁধ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বাসিন্দারা। জোয়ারের পানি ঠেকাতে বাঁধের অনেক স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটির দেয়াল তুলে উঁচু করেছেন এলাকাবাসী। গত বুধবার রাতের জোয়ারে কয়েকটি স্থানে নিচু বাঁধ উপচে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, কয়রা উপজেলা তিন দিকে নদীবেষ্টিত হওয়ায় জোয়ারের পানি বাড়লে অধিকাংশ বাঁধ ঝুঁকিতে থাকে।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে মেঘনার উত্তাল ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ঝোড়ো হাওয়াসহ নদী উত্তাল থাকায় ট্রলার নিয়ে তীরে চলে এসেছেন মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা। নিম্নাঞ্চল অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও রায়পুর উপজেলাসহ সদর উপজেলার আংশিক এলাকায় নদীতে স্বাভাবিকের তুলনায় তিন থেকে চার ফুট উচ্চতায় জোয়ার বইছে। রামগতির চর আবদুল্লাহ, বড়খেরী, কমলনগরের চর ফলকন, চরকাল কিনি, সাহেবের হাট, চর লরেন্স চর মার্টিন ও রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশীর চরকাচিয়া, চরখাসিয়া এবং সদর উপজেলার চর রমনী মোহন ইউনিয়নের প্রায় ২০টি এলাকার নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-বিহার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানকারী নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি দুর্বল হলেও বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য এখনও শঙ্কা কাটেনি। সে কারণে চারটি সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন কক্সবাজার, টেকনাফ, পেকুয়া, লক্ষ্মীপুর, কমলনগর, কয়রা ও পটুয়াখালী প্রতিনিধি)