আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়া পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হতে গ্রাহকের
১০০ কোটি টাকা আবুল কাশেমকে দিয়েছিল আলেশা মার্ট।
সরকারের সাবেক একজন পদস্থ ব্যক্তির কাছে ‘নতুন ব্যাংকের মালিক’ হওয়ার আশ্বাস পেয়ে ২০১৭ সালে দেশে আসেন আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহসভাপতি আবুল কাশেম। অনুমোদন পাওয়ার আগেই রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসে ‘প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক লিমিটেড’ নামে সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কার্যালয়ও খোলেন তিনি। এরপর ব্যাংকের পরিচালক বানানোর আশ্বাস দিয়ে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূলধন ও বাড়তি খরচ সংগ্রহ শুরু করেন। এভাবে কাটে প্রায় দুই বছর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পিপলস ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদন দেয়। নীতিগত অনুমোদন পাওয়া পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আবুল কাশেম। ওই অনুমোদনের পর বেঙ্গল কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করলেও পিপলস ব্যাংক আর আলোর মুখ দেখেনি।
শর্ত পালন করতে না পারায় ব্যাংকটির প্রাথমিক অনুমোদনও বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অনুমোদনের আগে ব্যাংকের নামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ আর ফেরত দেননি আবুল কাশেম। ব্যাংকের পরিচালক বানানোর কথা বলে এসব অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই টাকায় আবুল কাশেম গুলশানে কেনেন ফ্ল্যাট, কেনেন দামি গাড়ি।
জানা গেছে, পিপলস ব্যাংকের পরিচালক বানানো ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা বলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট থেকেও ১০০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন আবুল কাশেম। এ ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
পাশাপাশি তাঁর বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গত বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে আবুল কাশেম কারাগারে রয়েছেন।
আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে সিআইডির কাছে আবুল কাশেমকে বুঝিয়ে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরপর রিমান্ড চেয়ে তাঁকে আদালতে পাঠানো হলে শুনানির জন্য ২৫ জুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সেই সঙ্গে আবুল কাশেমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
কে এই আবুল কাশেম
পিপলস ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, আবুল কাশেমের জন্ম ১৯৫২ সালে। তাঁর বাবা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের রহমতপুরের আবু বকর সিদ্দিক। সন্দ্বীপের এবি হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে মাধ্যমিক, ওমর গনি কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও চট্টগ্রামের নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে বিএ সম্পন্ন করেন আবুল কাশেম। আশির দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে স্পারো কন্ট্রাকটিংয়ে কাজ নেন। ১৯৮৭ সালে গড়ে তোলেন কাশেম কন্ট্রাকটিং।
আবুল কাশেম ২০০৮ সালে জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার ১০ নম্বর সহসভাপতি। যুক্তরাষ্ট্রে নির্মাণব্যবসা রয়েছে তাঁর। ব্যাংক গঠনের জন্য আবুল কাশেম যেসব সম্পদের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেন, তার সব কটির সত্যতাও খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বুধবার তাঁকে আটকের পর নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসায় যোগাযোগ করলে তাঁর মেয়ে পরিচয় দেওয়া একজন নারী বলেন, আবুল কাশেম গত ডিসেম্বরে শেষবার ব্রুকলিনে গিয়েছিলেন। এর পর থেকে বাংলাদেশেই থাকতেন।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আবুল কাশেম ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ও তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে সচ্ছল পরিবার।
ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ যেভাবে
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ব্যবসা সীমিত করে ফেলেন আবুল কাশেম। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। তখন ওই ব্যক্তি আবুল কাশেমকে ব্যাংকের সনদ দেওয়ার আশ্বাস দেন।
এরপরই তিনি দেশে এসে পিপলস ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেন। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক গঠনে ৫০০ কোটি টাকা মূলধন লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া ব্যাংকটির আবেদনপত্রে পরিচালক হিসেবে ছিলেন দিশারি ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ফারজানা হোসাইন, তমা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক মুকিতুর রহমান, গাড়ি বিক্রয়কেন্দ্র কার সিলেকশনের মালিক আসলাম সেরনিয়াবাত, সুমি অ্যাপারেলসের প্রতিনিধি রেজাউল হোসেন, মদিনা ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহা. জাকির হোসেন পাটওয়ারী, খান ব্রাদার্স গ্রুপের এমডি তোফায়েল কবির খান, গুলশানের খন্দকার টাওয়ারের মালিক খন্দকার বদরুল আহসান, দিগন্ত সোয়েটারের প্রতিনিধি তানজিমা শাহতাজ, শোয়ান ইন্টারন্যাশনালের এমডি আমজাদ খান ও সাইনেস্ট অ্যাপারেলের প্রতিনিধি সামিহা আজিম। এ ছাড়া মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আলিম খানও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরিচালক হতে আগাম টাকা দিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে এখন সেই টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাংকটিকে লেটার অব ইনটেন্ট বা আগ্রহপত্রও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তবে তিন বছরে কয়েক দফায় সময় নিয়েও সেই আগ্রহপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি ব্যাংকটি।
এদিকে ব্যাংক গঠনের জন্য আবুল কাশেম যে অর্থ সংগ্রহ করেন, তার সব টাকা তিনি ব্যাংক হিসাবে জমা করেননি। আবার যেসব অর্থ জমা করেন, তা ব্যাংকের নামে না করে নিজ হিসাবে জমা করেন। আবার যাঁদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তাঁদের সবাইকে পরিচালক বা উদ্যোক্তা পদও দেওয়া হয়নি।
শুরুতে যাঁদের পরিচালক করা হয়েছিল, পরে তাঁদের কয়েকজনকে বাদ দিয়ে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান, তাঁর মা শিরিন আক্তারসহ নতুন কয়েকজনকে পরিচালক হিসেবে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ব্যাংকটি। পাশাপাশি শর্ত পরিপালনের জন্য আরও সময় চায়। সাকিব আল হাসান ওআবুল কাশেম ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানান।
তবে ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি নতুন করে সময় বাড়ানোর আবেদন নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিকে দেওয়া আগ্রহপত্রও বাতিল করা হয়। ফলে ভেস্তে যায় ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাকিব আল হাসান ৪০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকটির দুটি পরিচালক পদ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার রাতে বলেন, পিপলস ব্যাংক বলতে দেশে কিছু নেই। অনেক আগেই এর উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। যাঁরা পরিচালক হওয়ার জন্য টাকা জমা দিয়েছেন, তাঁরা নিজ দায়িত্বে দিয়েছেন। তাঁদের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার নেই।
পিপলস ব্যাংক গঠনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় । তাঁরা জানান, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার আশায় কাশেমের সঙ্গে যুক্ত হন অনেকে। এখন ব্যাংকও হয়নি, টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
আবুল কাশেমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি (আবুল কাশেম) নিউইয়র্ক সিটির একজন তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। নব্বইয়ের দশকে তিনি নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে একটি বাড়ি কেনেন। সাম্প্রতিক সময়ে আরও দুটি বাড়ি কিনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে সন্দ্বীপে তিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আলেশা মার্টের টাকাও কাশেমের কাছে
২০২০ সালের ২৬ জুলাই আলেশা মার্ট যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে আলেশা মার্টের যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি।
প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হতে এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া ১০০ কোটি টাকা আবুল কাশেমকে দিয়েছিলেন আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার। ফলে আলেশা মার্টের গ্রাহকদেরও বড় অঙ্কের টাকা আটকে গেছে আবুল কাশেমের কাছে।
এ ঘটনায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার, তাঁর স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী, পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে সিআইডি। সম্প্রতি রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এসপি) আল মামুন। এরপরই আবুল কাশেমকে আটক করা হয়।
কেনেন ফ্ল্যাট ও গাড়ি
২০১৭ সালে দেশে আসার কিছুদিন পর প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হতে আগ্রহী এক ব্যক্তি আবুল কাশেমকে গুলশানে একটি বাসা ভাড়া করে দেন। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভেস্তে গেলেও তিনি গুলশান-২ এলাকার ১০৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির ওই ফ্ল্যাট কিনে নেন। আটকের পর ওই বাসার নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায় তাঁর ঢাকা মেট্রো-গ-৪৫-৭৮২১ নম্বরের গাড়িটি।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল অর্থ পাচার প্রতিরোধে নিয়োজিত সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে ১ জুন একটি চিঠি দেন।
সেখানে বলা হয়, আবুল কাশেমের হাতে ব্যাংক চেয়ারম্যান হওয়ার মতো সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় ৪০ কোটি টাকার সম্পদ দেখান। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের মালিক মঞ্জুর আলম শিকদার যুক্তরাষ্ট্রে আবুল কাশেমের কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, মানুষ এখন বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন উপায়ে টাকা উপার্জন করছেন। ব্যাংকের মালিক হওয়া প্রতিপত্তির বিষয়, এ জন্য অনেকেই তাঁকে টাকা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক অনুমোদন দিয়ে তাঁকে স্বীকৃতিও দিয়েছে।
আসলেই দেশে ব্যাংকের প্রয়োজন আছে কি না, তা বিবেচনা করা হয়নি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য একটা ভালো মানদণ্ড ঠিক করা উচিত।
শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক মর্যাদাও বিবেচনা করা উচিত। তাহলে প্রতারণার কারণে জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
[তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেছেন নিউইয়র্ক সংবাদদাতা]